তাঁরা করোনাকালের সাহসী স্বেচ্ছাসেবক

করোনায় মারা যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা মজিবুর রহমান তালুকদারের লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার শাকপালা এলাকায়। ছবি: সংগৃহীত
করোনায় মারা যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা মজিবুর রহমান তালুকদারের লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার শাকপালা এলাকায়। ছবি: সংগৃহীত

করোনা সন্দেহে বা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার খবর পেলেই তাঁরা ছুটে আসেন। মরদেহ সংগ্রহ করে গোসলসহ পরম যত্নে দাফন সম্পন্ন করেন তাঁরা। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের হয়ে এই দাফন প্রক্রিয়ার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক। এর মধ্যে বগুড়ায় আছেন ১৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে লাশ সৎকারের মানবিক এই দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা।

এই স্বেচ্ছাসেবকেরা গত এক মাসে উত্তরাঞ্চলে ২২ জনের দাফন সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে ছয়জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বাকিরা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে শুধু বগুড়াতেই আটজনের দাফন সম্পন্ন করেছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাঁদের মধ্যে চারজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং বাকি চারজন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে বগুড়ার সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সাংসদ ও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক কামরুন্নাহার পুতুল গত বৃহষ্পতিবার রাতে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। খবর পেয়ে রাতেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা হাসপাতালে গিয়ে বিশেষ ব্যাগ ও পলিথিনসহ লাশ সংরক্ষণের উপকরণ সরবরাহ করেন। এরপর দুজন নারীসহ নয়জন স্বেচ্ছাসেবক শুক্রবার দুপুরে বগুড়া শহরের কালিতলা এলাকায় সাংসদের বাসায় গিয়ে মরদেহ গোসল থেকে শুরু করে কাফনের কাপড় পরানোর কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। বিকেলে আইইডিসিআরের নির্দেশনা মেনে বাসা সংলগ্ন গলিতে সীমিত কয়েকজনের অংশগ্রহণে জানাজা শেষে শহরের আঞ্জুমান নামাজগড় গোরস্থানে লাশ দাফন করেন স্বেচ্ছাসেবক দলটি।

এর আগে সোমবার রাতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ঢাকা মহানগর পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মজিবুর রহমান তালুকদারের দাফন সম্পন্ন করেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা। রাত আটটার দিকে বগুড়া শহরের পাশে শাকপালা এলাকায় আইইডিসিআরের নির্দেশ মোতাবেক সীমিত মুসল্লি নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

জেলা পুলিশ ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ গোসল থেকে শুরু করে আইইডিসিআরের নির্দেশনা মোতাবেক কাফনের কাপড় পরিয়ে ব্যাগে ভরিয়ে দেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা। লাশ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স বগুড়ায় পৌঁছানোর পর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্থানীয় ৬ জন স্বেচ্ছাসেবকের একটি দল পুলিশ কর্মকর্তার লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করেন।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল আইসোলেশনের দায়িত্বে থাকা আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শফিক আমিন জানান, বগুড়া স্বেচ্ছাসেবক দলটিতে কেউ আইনজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ফ্যাশন ডিজাইনার, কেউ শিক্ষার্থী। নারীদের দাফনের জন্য তিনজন নারী স্বেচ্ছাসেবকও প্রস্তুত রয়েছেন। করোনায় কেউ মারা গেলে স্বেচ্ছাসেবক দলকে ফোন দিলেই তাঁরা কাফনের কাপড় নিয়ে ছুটে আসেন। মরদেহ গোসল, কবর খোঁড়া, জানাজা, দাফন—সবকিছুই করেন তাঁরা।

স্বেচ্ছাসেবক দলে রয়েছেন বগুড়া বার সমিতির একজন তরুণ আইনজীবী। তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা নমুনা পরীক্ষার আগে কেউ মারা গেলে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বা মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আইসোলেশন থেকে তাঁদের ফোন দেওয়া হয়। কাফনের কাপড় আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের হয়ে ৬-৭ জনের একটি দল সঙ্গে সঙ্গে ছোটেন হাসপাতালে কিংবা ঢাকায় মারা গেলে সেই ব্যক্তির বাড়িতে। এরপর যাবতীয় কাজ তাঁরা সম্পন্ন করেন।

এই স্বেচ্ছাসেবক জানান, এ পর্যন্ত দাফন করা অন্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন—করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১২ এপ্রিল ঢাকায় মারা যাওয়া সোনাতা উপজেলার বাসিন্দা ও আনসার বাহিনীর কমান্ডার আবদুল মজিদ, ১৮ মে ঢাকায় মারা যাওয়া এসআই মজিবুর রহমান, করোনা সন্দেহে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আইসোলেশনে মারা যাওয়া সোনাতলা উপজেলার সিরাজুল ইসলাম, ১ মে মারা যাওয়া বগুড়া সদরের সাবগ্রামের জাকিরুল, ২১ এপ্রিল মারা যাওয়া সোনাতলার হাবিবুর রহমান ও ৩ মে মারা যাওয়া গাবতলীর দুর্গাহাটার আবদুল হান্নান।

করোনায় মারা যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা মজিবুর রহমান তালুকদারের লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার শাকপালা এলাকায়। ছবি: সংগৃহীত
করোনায় মারা যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা মজিবুর রহমান তালুকদারের লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার শাকপালা এলাকায়। ছবি: সংগৃহীত

অপর এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের কোনো সদস্য করোনায় আক্রান্ত হননি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি মেনে লাশ দাফনের জন্য তাঁরা একাধিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নিজেরা সুরক্ষা সরঞ্জাম পরেই ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজ করেন। এতে কোনো ভয় কাজ করে না। উল্টো প্রতিটি লাশ দাফনের পর মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ কাজ করে। তবে পিপিই, গ্লাভস, চশমাসহ পুরো পোশাক পরে গরমের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা কষ্ট হয়। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা ভয় পাবেন বলে তাঁরা তাঁদের কর্মকাণ্ড সবার কাছ থেকে গোপন রাখছেন।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বগুড়ার সংগঠক মিজানুর রহমান বলেন, দাফনে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য পিপিই, মাস্ক, ফেস শিল্ড, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, হেভি গ্লাভস, নেক কভারসহ ১৩ রকমের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেন তাঁরা। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক লাশ দাফনের জন্য ভাইরাসরোধী বিশেষ ব্যাগসহ ২৭ রকমের সুরক্ষা সামগ্রী ও তিন ধরনের জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি মরদেহ সৎকারের পর সুরক্ষার জন্য পিপিইসহ পরিধেয় অন্য সামগ্রী কবরস্থানেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রতিটি দাফনে গড়ে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এই অর্থ জোগান দেয়।