আদর্শ কুমিরমারা গ্রামের কৃষকেরা এখন নিঃস্ব

ক্ষতিগ্রস্ত সবজির চারা বাঁচিয়ে রাখতে এক কৃষকের চেষ্টা। ছবি: প্রথম আলো
ক্ষতিগ্রস্ত সবজির চারা বাঁচিয়ে রাখতে এক কৃষকের চেষ্টা। ছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামটি ছিল সবজি চাষের জন্য আদর্শ একটি গ্রাম। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে গ্রামের সবজিচাষিরা লাভ তো দূরের কথা, শ্রম-অর্থ সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব।

কুমিরমারা গ্রামের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মালিকের জমি রেখে প্রায় সারা বছরই সবজি-শাকের আবাদ করেন। এখন সেখানকার জমির ফসল জমিতেই শেষ হয়ে গেছে।

কথা হয় সবজিচাষি আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৬ মণ ধানের চুক্তিতে ৫০ শতক জমি সবজি চাষের জন্য অন্যের কাছ থেকে রেখেছেন। আট হাজার টাকা খরচ করে তাতে বেড (কান্দি) করেছেন। বীজ কিনেছেন ১০ হাজার টাকার। এ জমিতে খেত তৈরি করে বর্ষাকালীন আগাম সবজি চিচিঙ্গা, ঝিঙে, শসার আবাদ করেন। চারা গাছগুলো কেবল ৫-৬ ইঞ্চি বড় হয়েছে। টানা খরায় সেচ দিয়ে রক্ষা করেছেন পাঁচ শতাধিক ঝিঙে, দুই শতাধিক চিচিঙ্গা এবং তিন শতাধিক শসার মাদা। পুরোপুরি খেত প্রস্তুত করতে তাঁর প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু আম্পানের ঝোড়ো হাওয়ায় তাঁর খেতের এক-চতুর্থাংশ চারা নষ্ট হয়ে গেছে। চারা গাছগুলো নেতিয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে শুকিয়ে মরে যাবে।

কৃষক রাজ্জাক আরও বলেন, ‘শুধু লাউ বিক্রি থেকেই ১০ হাজার টাকা আয় করতে পারতাম। দুই লাখ টাকার চিচিঙ্গা, ঝিঙে, শসা বিক্রির স্বপ্ন ছিল। ঝড়ে সব স্বপ্নই তছনছ হইয়া গেছে।’

শুধু আবদুর রাজ্জাক একা নন। কৃষক আবদুল মান্নান হাওলাদারের ১২০ শতক জমির লাউ, চিচিঙ্গা, ঝিঙেসহ সবজির ফলন ধরা গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন খেতের চারাগুলো শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জমির মালিককে বছরে ৪০ মণ ধান দেওয়ার শর্তে এ জমিতে তিনি সবজি খেত করেছিলেন।

চাষি রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি পুঁইশাকের খেত করেছিলাম। তা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। পাতায় লাল লাল দাগের চিহ্ন পড়েছে। এ শাক এখন কেউ কিনবে না। আমার বিক্রির মতো প্রায় ১০০ মণ শাক মাঠেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ শাক ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারতাম।’
একই দশা নীলগঞ্জ ইউনিয়নের এলেমপুর, আমিরাবাদ, পূর্ব সোনাতলা, মজিদপুর, গুটাবাছা, নাওভাঙা, গামইরতলার চাষিদের। এসব চাষির লাউ, ঢ্যাঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, করলা, শসা, কাঁচা মরিচ, বোম্বাই মরিচের ফলন নষ্ট হয়ে গেছে। গোটা নীলগঞ্জে এক হাজার কৃষক পরিবার এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সবজিসহ এক লাখের মতো চারা গাছ নষ্ট হয়ে গেছে।

আবদুল বারেক হাওলাদার নামের এক চাষি বললেন, কৃষি প্রণোদনা তো দূরের কথা করোনার দুর্যোগ থেকে এখন পর্যন্ত এক ছটাক সাহায্যের চাল ভাগ্যে জোটেনি। আম্পানের তাণ্ডবের পরে কৃষি বিভাগের কোনো কর্মকর্তা তাঁদের খোঁজখবর নেননি বলে জানালেন চাষিরা।

স্থানীয় সবজিচাষিদের কাছ থেকে জানা গেল, আম্পানের ঝোড়ো হাওয়ায় কুমিরমারা গ্রামটির দেড় শতাধিক শাক-সবজিচাষির কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গোটা উপজেলায় প্রায় ছয় হাজার সবজিচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারপরও এসব সবজিচাষিরা নতুন করে সবজির খেত তৈরি করার চেষ্টা করছেন। সবজিচাষিরা তাঁদের খেতের বাস্তব ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিপূরণের দাবি করেছেন।

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হিসাবমতে এক হাজার হেক্টর সবজির খেতের ৭০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া আম্পানের তাণ্ডবে ৫০ হেক্টর মিষ্টি আলু, ৫৫০ হেক্টর মরিচ খেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সবজিচাষিদের তালিকা করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।’