'করোনায় ইনকাম শেষ, আম্পানে মাথা গোঁজার ঠায় হারালাম'

খুলনার দাকোপের বানীশান্তা যৌনপল্লি আম্পানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নদীতে হারিয়ে যাওয়া ভিটা দেখাচ্ছেন নারী। শনিবার বিকেলে। ছবি: উত্তম মণ্ডল
খুলনার দাকোপের বানীশান্তা যৌনপল্লি আম্পানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নদীতে হারিয়ে যাওয়া ভিটা দেখাচ্ছেন নারী। শনিবার বিকেলে। ছবি: উত্তম মণ্ডল

প্রমত্তা পশুর নদে সবে ভাটার টান শুরু হয়েছে। পাড় থেকে আস্তে আস্তে পানি নামার সঙ্গে ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে নদীর জেগে ওঠা পাড়েই। পাড় ধরে সরু চলার পথ দিয়ে এগোতেই চোখে পড়ল মাঝবয়সী এক নারীকে। যিনি বিষণ্ন মনে রোদে দেওয়া আধভেজা বালিশ আর তোশক উল্টে দিচ্ছেন।

চোখে চোখ পড়তেই নিজ থেকেই বললেন, 'এমনিতেই ম্যালা অসুবিধেয় দিন যাচ্ছে। আম্পান যেন করোনার মধ্যি আরেক করোনা হুইয়ে আসল। দুঃখের ওপর দুঃখ। দোকান, ঘর, খাট, সৌর বিদ্যুতের প্যানেল সব ঝড়ে নিইয়ে গ্যাছে। বালিশ, তোশক আর একটা পানির ট্যাংক শুধু খুঁজে পায়িছি।'

খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের বানীশান্তা যৌনপল্লিতে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিলেন সেখানকার বাসিন্দা সখিনা। ১৯৮৩ সালের দিকে তিনি এই পল্লিতে আসেন। ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়, এরপর সিডর, আইলার মতো বড় ঘূর্ণ ঝড় আর পশুর নদের উন্মত্ততা দেখেছেন। তবে আটাশির পর এবারের আম্পানের মতো বড় ক্ষতি আর কখনো তাঁদের হয়নি। আর ঈদে একদমই কিছু কিনতে পারেননি, এমন কবে হয়েছে তা মনে করতে পারলেন না সখিনা।

প্রায় সব হারানোর বেদনা নিয়ে নদের দিকে তাকিয়ে সখিনা ফিরে গেলেন ৩০-৩৫ বছর আগের স্মৃতিতে। বললেন, 'তখন মোংলা বন্দর অন্যরকম ছিল। এই জায়গার পশুর তখন এত বড় ছিল না। বন্দরে অনেক জাহাজ আসত। আমাদের এই পল্লির হ্যাজাকের আলো মোংলায় গিয়ে পড়ত। জাহাজ ঘোরানোর সময় প্রায় আমাদের পল্লির কাছাকাছি লেগে যেত। আমরা জাহাজের ক্রুদের দিকে “হাই মাই ফ্রেন্ড” বলে চিৎকার করতাম।। তাঁরা পলিথিনের ব্যাগে ভরে বিভিন্ন ফল আর খাবার দিত। আমরা চরে নেমে সেগুলো সংগ্রহ করতাম। পল্লিতে আটশোর ওপরে আমাদের মতো যৌনকর্মী ছিল।'

পাশে বসা নাসিমা জানান, প্রায় চার মাস হতে চলল করোনার কারণে তাঁদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ। অনেক কষ্টে ঘর তুলেছিলেন। সেখানে ঘর প্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ভাড়া পেতেন। করোনার জন্য অবশ্য মেয়েদের (যৌনকর্মী) কাছে ভাড়ার টাকা বকেয়া পড়ছিল। আর আম্পানে তাঁর পাঁচটি ঘর পুরো ভেসে গেছে। এই পল্লির কিছু মানুষ এখন আর এই পেশায় নেই। ঘর-সংসার পেতে আশপাশের গ্রামে থিতু হয়েছে। ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় অনেকে এখন সেখানে আপাতত ভাড়া থাকছে।

নাসিমা বলেন, 'আমাদের রেডিও আছে। দুদিন আগে থেকে মাইকিংও হয়েছে। কয়েকটা ছাগল, হাঁস, মুরগি আছে, তা রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাইনি। তবে শেষ বেলায় গেছি। আবার রাত তিনটের দিকে ঝড় থামলেই ফিরে এসে দেখি সব শেষ। খাট, হাঁড়ি-পাতিল, চুলা পর্যন্ত নেই। গত দুদিন কিছু রান্না হয়নি। একটা সংস্থা থেকে দুদিন খাবার দিয়ে গেছে। সোলার প্যানেল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। এখন হ্যারিকেন জ্বালছি।'

শনিবার ওই যৌনপল্লি ঘুরে এবং যৌনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাঁধ হচ্ছে, তবে ওই যৌনপল্লির বাইরে পড়েছে। বন্দর আর তেমন জমজমাট না থাকায় তাঁদের আয় এমনিতেই কমেছে। করোনায় আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে নদীতে জাল টেনে পোনা ধরছেন। আর আম্পান তাঁদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। ওই পল্লির প্রায় সব ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে। ঘরের নিচে থেকে মাটি সরে গেছে। ত্রাণের চাল, ঘর, খাট দোকান ভেসে গেছে। অনেকে পল্লি ছেড়ে আশপাশে ভাড়া থাকছেন। পানি আর শৌচাগারের সংকট তীব্র হয়েছে। বাড়িওয়ালাদের চেয়ে ভাড়াটিয়া যৌনকর্মীদের কষ্ট বেড়েছে বেশি। আয় বন্ধ থাকায় এবং হাতে নগদ টাকা না থাকায় কীভাবে আর ঘরবাড়ি, খাট- আসবাব ঠিক করবেন, মিস্ত্রি কোথায় পাবেন তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছেন তাঁরা।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত পশুর নদীর তীরবর্তী এলাকা। শনিবার খুলনার দাকোপের বানীশান্তা। ছবি: উত্তম মণ্ডল
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত পশুর নদীর তীরবর্তী এলাকা। শনিবার খুলনার দাকোপের বানীশান্তা। ছবি: উত্তম মণ্ডল

পল্লির বাসিন্দা লীলা বলেন, 'নদীর কারণে সামনে ভাঙে আমাদের পিছিয়ে যেতে হয়। এই পল্লিতে এত দুঃসময় আর আসেনি। চার মাস সবার কাজ বন্ধ। এরপর ঝড় দোকানপাট ঘরবাড়ি ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেছে। উপায় না পেয়ে অধিকাংশ মেয়েরা নদীতে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে পোনা ধরছে। পেটতো চালাতে হবে।'

দেশের উত্তরের এক জেলা থেকে বছর ছয়েক আগে এই যৌনপল্লিতে এসেছেন তহমিনা। এত বড় ঝড় এর আগে তাঁর দেখা হয়নি। তিনি বলেন, ঝড়ে এখানকার রাস্তাঘাট আর নেই। চার মাস ব্যবসা নেই। লকডাউনের পর থেকে মাঝে মাঝে কিছু চাল-ডাল পাওয়া গেছে। তা দিয়ে কী আর চলে। নগদ টাকা কারও কাছে নেই, আয় নেই। কীভাবে ঘরবাড়ি আবার ঠিক করবেন?

আধভাঙা ঘরের পাশে ঝড়ে শিকড় উপড়ে শুকিয়ে যাওয়া একটা নিম গাছ দেখিয়ে এই প্রতিবেদককে তহমিনার বললেন, 'আমাদের অবস্থা এখন এ রকম। ঝড়ে একবারে সব নিয়ে গেলে ভালো হতো। এই পথে আর কারও থাকা লাগত না। ভাঙা ঘরবাড়ি দেখলে কষ্ট বাড়ছে। আগে ছয় টাকা কলস পানি আনিয়ে নিতাম। এখন রাস্তা নেই পানি দেওয়ার মানুষ আসছে না। জোয়ারে কোমর সমান পানি হচ্ছে। লোনা পানিতেই গোসল সারছি। ঝড়ের পর চুলা নেই, রান্না নেই। আপনাকে যে বসতে দেব সেই ব্যবস্থা এখন নেই।'

এই যৌনপল্লিতে ৩৭টি বাড়িতে ৩০০ এর মতো ঘর আছে। আর যৌনকর্মী আছেন সব মিলিয়ে ৯৩ জন। প্রায় ৫৫জন যৌনকর্মী ভাড়ায় থাকেন। ভাড়ায় থাকেন এ রকম একজন যৌনকর্মী হলেন মালা। তিনি বলেন, ' আম্পানের পর থেকে যেসব ঘরবাড়ি আছে, তা জোয়ারে ভাসছে। লকডাউনের পর ত্রাণে যা কিছু পেয়েছিলাম সব ভেসে গেছে। যারা বাড়িওয়ালা তাঁদের ক্ষতি হয়েছে। তবে আমাদের অবস্থা আরও খারাপ। যা ইনকাম করতাম, তা খেয়ে দেয়ে বাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকত না। এখন ইনকাম বন্ধ। আমাদের মুদি দোকানে বাকি হচ্ছে। সন্তানদের ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারছি না।'

যৌনপল্লিতে পুরুষের বসবাস বেশ কম। তবে বিশেষ প্রয়োজনে এবং নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে কিছু পুরুষের বসবাসের অনুমতি মেলে। সে রকমই একজন লিটন চৌধুরী। সাত বছর বয়স থেকে এখানে বাস করছেন। এখন বয়স চল্লিশের কোটায়। আম্পানের আঘাত হানার রাতে তিনি ওই পল্লিতেই ছিলেন। ওই রাতেই অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বললেন, 'আইলা- সিডরেও এত তুফান হয়নি। পানি এত ওপরে ওঠেনি। এত ভাঙেনি। দোকানপাট, ঘর, চাল-ডাল সব নিয়ে গেছে। একেটা ঘর চোখের সামনে দিয়ে তীব্র গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে জোয়ার। এরপর মাঝরাতে ভাটা শুরু হলেও পানি দু-তিন ফুটের কম কমতে আবার জোয়ার শুরু হয়। মানে ডাবল জোয়ারের মুখোমুখি হই আমরা। ঘরের মধ্যে পানি উঠে যাওয়ার পর দুটি প্লাস্টিকের ড্রাম নিয়ে বসে ছিলাম। রাত তিনটের দিকে নদী পুকুরের মতো শান্ত হয়ে যায়।'

ওই পল্লির মানুষ যার ওপর সবকিছুতে ভরসা খোঁজেন তিনি রাজিয়া। নারী জাগরণী সংঘের সভানেত্রী। সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর কাজ শেষ করতে করতে ঝড় এমনভাবে চলে আসে তাঁর আর আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া হয়নি। ঘরে কোমর সমান পানি হওয়ার পর ভীষণ ভয় পেয়ে যান তিনি।

রাজিয়া বলেন, 'সিডরে তেমন বড় কিছু হয়নি। এবার খুব ক্ষতি হয়েছে। এরপরও আবার চুরিও হয়েছে। ঝড়ের পর চেয়ারম্যান-মেম্বার বোটে করে একবার দেখে গেছে। বিকেলে একটু খিচুড়ি দিয়েছে। এরপর আমরা খাইয়ে আছি, না নাখাইয়ে আছি, না মারা গেছি তা কেউ খোঁজ নেয়নি। আমরা সবচেয়ে কঠিন লকডাউন মেনেছি। পল্লিতে পাহারা বসিয়েছি, যেন কেউ না আসতে পারে। অথচ লকডাউনের পর থেকে সরকারিভাবে ১৩ কেজি করে চাল আর ৫০০ করে টাকা পেয়েছি। আইডি কার্ড আর মোবাইল নম্বার নিয়ে গেছে, তবে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহারের টাকা আমরা পাইনি। তবে বিভিন্ন সংস্থা আমাদের কিছু সাহায্য করেছে।'

এমন বিপদগ্রস্ত পরিস্থিতিতে ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে রাজিয়া বলেন, 'করোনায় আয়-ইনকাম সব শেষ, আর আম্পানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারালাম। এবার ঈদে পল্লির কারও হাসিমুখ দেখতে পাব না।'