কেমন আছ প্রিয় ক্যাম্পাস

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

কেমন আছ প্রিয় ক্যাম্পাস? কেমন আছে তোমার বুকের ওপরে প্রতিষ্ঠিত একাডেমিক ভবনগুলো? সেগুলো কি এখনো মুখরিত হয় শিক্ষার্থীদের পদচারণে। তুমি কি আর অনুভব করো না কচি কচি শিক্ষার্থীদের পবিত্র পায়ের চঞ্চলতা। নাকি নিঃসঙ্গ রাত্রির গভীরতার মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছ তুমি হাজারো রাতের তারাকে সঙ্গী করে।

তুমি কি তাদের বেদনায় ব্যথিত হয়ে কেঁদে ওঠো না ডাহুক পাখিকে সঙ্গে নিয়ে। নাকি তোমার বুকের আসনগুলো দখল করে আছে প্রকৃতির জোনাকি পোকা কিংবা ডুমুরের গাছে স্থান নেওয়া বাদুড় আর চামচিকেরা। যারা এত দিন স্থান পায়নি বনে-বাদাড়ে আর সবুজ গাছের ছোট ছোট ডালে। নাকি তোমার বুকের ওপর ধুলার আস্তরণ জমে জমে কাঠরং থেকে ধুলারং হয়ে আছে।

তুমি কি কাঁদছ না তোমার ফুলের জন্য? যে ফুলেরা তোমার বাগানকে সাজিয়ে রেখেছিল, শোভা বর্ধন করেছিল, তোমার বিশাল বুকে। যারা তোমাকে হইহুল্লোড় করে মাতিয়ে রাখত সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। তোমার কি একটুও মনে পড়ে না তাদের কথা।
হয়তো তোমার খোলা পিঠে সবুজ ঘাসগুলো বড় হতে হতে নেতিয়ে পড়েছে উবু হয়ে একটার ওপর আরেকটা। আর তার ভেতরে ঘাসফড়িংয়েরা আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে পাল্লা দিচ্ছে একজনার সঙ্গে আরেকজনার। দূর থেকে উড়ে আসা অচেনা পাখিরা কিংবা কাকেরা জটলা করে উড়ে এসে তাদের ধরার চেষ্টা করছে অথবা বৃষ্টিতে নরম হয়ে যাওয়া মাটি আলগা করে কোনো অচেনা পোকা আর কেঁচোকে ধরে ধরে তাদের তৃপ্তি মেটাচ্ছে আনন্দে। তুমি তো জানো শিক্ষার্থীরা কত আনন্দে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, হ্যান্ডবল খেলত তোমার প্রশস্ত আর গোলাকার খোলা বুকে। আর যারা কিছুই খেলত না তারাও কখনো মনের অজান্তেই দিত ভোঁ-দৌড়। কখনো কখনো হয়তো তুমি বিরক্ত হতে শক্ত বুটের আঘাতে। কিন্তু পরক্ষণেই তুমি ভুলে যেতে যদি কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত তোমার বুকেই। তখন তুমি তাকে আদর করে দিতে বুকে জড়িয়ে মায়ের মতো। আর বলতে, কোথায় ব্যথা পেয়েছ বাবা সোনা আমার, খুব বেশি কি লেগেছে? হয়তো এখন তোমার মন শূন্য মায়ের বুকের মতোই কাঁদছে কিংবা পথ চেয়ে অপেক্ষায় আছো কবে ফিরবে তোমার সন্তানেরা। কবে তোমার বুকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে লাল-সবুজের পতাকা তোলার পর প্রতিজ্ঞা করে সাবধান অবস্থায় গেয়ে উঠবে সমস্বরে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

আকাশমণি আর মেহগনির গাছগুলো সাদা মেঘের সঙ্গে কথা বলছে নীরবে আর মাঝেমধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে। তারা জমিয়ে রেখেছে বুকের গভীরে অনেক অজানা কথার ইতিহাস। কিন্তু এমন নিঃসঙ্গতার ভাগীদার তারা কখনো হয়নি এর আগে। তাই করোনা-কালের কষ্ট মেহগনির রং ধারণ করে শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে তারা আজ। ব্যথায় থরো থরো তাদের দেহ। পাতার সবুজ রং কালচে হয়ে আসছে ক্রমাগত। কাঁঠাল আর আমগাছগুলো কেমন বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে ফলভারে। আমলকী আর সফেদা কিছুটা মুক্তি পেয়েছে আগেই। জবা, কলাবতী, সন্ধ্যা, গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা আর ঘাসফুলেরা শুধু শুধুই ফুটে লজ্জা পাচ্ছে অধ্যক্ষ স্যারের কক্ষের প্রবেশমুখে। হয়তো এখনো প্যাঁচা আর চিলেরা এসে বসে আমাদের স্ট্যাফ রুমের পাশে থাকা নাম না–জানা গাছের মগডালে। মাঝেমধ্যে হয়তো উড়াল দেয় তারা কোনো শিকার ধরতে। অথবা দূরে কোথাও চলে গেছে তারা বাসা বানাতে। ফিরে আসবে ছানাসহ অচিরেই।

কেমন আছ বাদামি শিয়ালেরা? তোমরা হয়তো বেশি ভালো আছ। কারণ, তোমাদের আর দৌড়াতে হচ্ছে না কোথাও কারও ভয়ে। চোখ বুজে, পা ছড়িয়ে, রোদ গায়ে মেখে, আরামে শুয়ে আছ তোমরা পশ্চিম দিকের না ফোটা কাশফুলের বনে। হয়তোবা ঝগড়া করছ প্রিয়জনের সঙ্গে। কিংবা লেজ উঁচু করে দৌড় দিচ্ছ কেউ কেউ এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। মাঝেমধ্যে হয়তো হাঁপিয়ে উঠছ শিক্ষার্থীদের না দেখে। কারণ তারা তো তোমাদের কোনো দিন কোনো ক্ষতি করেনি। বরং তারা নিশ্চয়তা দিয়েছে তোমাদের নিশ্চিতে বসবাসের।

প্রিয় গ্রন্থাগার নিশ্চয়ই তুমি ভালো নেই। ভালো থাকতে পারো না। তুমি তালাবন্দী থাকতে ভালোবাসো না কখনো। তুমি মনে মনে ভাবছ কবে খুলবে তোমার শৃঙ্খলা কবে মুক্তি পাবে তুমি। হয়তো তোমার ভেতরে থাকা হাজারো পবিত্র বইয়ের ওপরে ধুলার আস্তরণ জমা হয়ে আছে কিংবা তুমি মলাটবন্দী অবস্থায় তাকে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছ। ভাবছ কবে আমার কালো বর্ণের ওপর চোখ বোলাবে জ্ঞানপিপাসুরা। আর আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়তে থাকবে কোন গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাসের বই। প্রিয় গবেষণাগার তুমি কি ভালো আছ শিক্ষার্থীদের ছাড়া? মনে হয় তোমার বুকে জং ধরেছে? তুমি আর পারছ না এ জ্বালা সহ্য করতে। দিন গুনছ কবে শিক্ষার্থীরা তোমার উপাদান ব্যবহার করে জ্ঞানের জানালাকে উন্মুক্ত করবে আগের মতো।

প্রিয় অডিটরিয়াম হয়তো তোমার বুকের আসনগুলো ফাঁকা ময়লা অবস্থায় পড়ে আছে। অপেক্ষায় আছ কবে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক আর কুইজ প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। কিংবা তুমি অপেক্ষায় আছ কোনো এক শনিবার সকালের কিংবা সপ্তাহের কোনে এক কর্মদিবসের সমাপ্তির জন্য। যেখানে অধ্যক্ষ স্যার অথবা ভিপি স্যার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করবেন শিক্ষকদের উদ্দেশে।

প্রিয় ক্যাম্পাসের ফটক, এখনো কি জটলা হয় তোমার সামনে। এখনো কি শিক্ষার্থী বা অভিভাবকেরা চানাচুর কিংবা মুড়িমাখা অথবা ফুচকা খাওয়ার লোভে জটলা করে। অথবা শিক্ষার্থীরা আইসক্রিমে কামড় দিতে দিতে বন্ধুর সঙ্গে কোনো নতুন দেখা সিনেমা নিয়ে গল্পে কিংবা দুষ্টামিতে মেতে থাকে। এখনো কি অপেক্ষা করে ড্রাইভার তাদের গাড়ি নিয়ে শিক্ষাথীদের নেওয়ার জন্য। এখনো কি হাত পেতে থাকে পা কাটা ভিক্ষুক অথবা ময়লা শাড়ি পরা কোনো ভিক্ষুক। যাঁরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের পাঁচি কিংবা ভিখুর মতো কিংবা তাদের মতো কেউ নন, শুধু অভাবী। তাঁরা পেটের দায়ে হাত পাতেন বা অভাবের কারণে হাত পাতেন।

প্রিয় ক্যাম্পাস কেমন আছ তুমি? তুমি কি ভালো আছ আদতে! ভালো থাকতে পারো তুমি আমাদের ছাড়া? প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়েই পত্রিকার দিকে তাকাই হয়তো কোনো কলামে লেখা আছে স্কুল আগামীকাল কিংবা আগামী সপ্তাহে খুলছে। অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আবার মুখরিত হবে ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বর। ঘণ্টা বেজে উঠবে ক্লাসে যাওয়ার। কিন্তু সে সংবাদ আসে না। সংবাদ আসে না কোনো খোলা ডাকের চিঠিতে কিংবা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর জবান থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য। তবে আশা করছি আমরা সবাই, গোটা পৃথিবীতে আবার শান্তি নেমে আসবে। মানুষের মাঝে আসবে আবার স্বাভাবিকতা। গতি আসবে জীবনের। শেষ হবে করোনা নামের মহামারির।

* লেখক: সহকারী শিক্ষক (বাংলা), ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, রংপুর