স্যালুট ডাক্তার ও নার্সদের

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

স্রষ্টার পরে নিয়ামক কে?

ডাক্তার, বলে মাথা উঁচু করে ডান হাত দিয়ে স্যালুট।
বজলুর রশিদের পা থরথর করে কাঁপছে। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ঢাকায় ঘন কালো মেঘ। কী করবে বজলু মিয়া, হিমশিম খাচ্ছে। ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা। ঢাকায় আনতে হবে। কোথাও তার ভরসা নেই। বাড়ির কাছে বড় হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ। তাতে কী! ঢাকাই চাই, ঢাকায় আনতে হবে! অভিজ্ঞ ডাক্তার, আর সব অভিজ্ঞ হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট।

আত্মীয়স্বজন, সবাই নাখোশ। না, ঢাকায় নেওয়ার সময় নেই। খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা। ঘটনা ঘটেছে গত সন্ধ্যায়। ১২ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। স্ট্রোকের রোগী। এ ধরনের রোগীর ১ ঘণ্টার মধ্যে টিস্যু প্লাজমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর (টিপিএ) নামক ক্লট-দ্রবীভূত ওষুধ দিতে হয়, অবস্থা বুঝে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব রোগ নিরাময়ে যেতে হয়।

স্ট্রোক—চিকিৎসককে দ্রুত জমাটবাঁধা রক্ত সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হয়। আর হেমোরেজিক স্ট্রোক—চিকিৎসককে দ্রুত রক্তপাত বন্ধ করতে হয়।

কোনো চিকিৎসা হয়নি। আমরা বাঙালি খুব আবেগপ্রবণ, একটু কিছুতেই কান্নাকাটি। কাজের কাজ কিছুই নেই।

বজলু মিয়ার শক্ত সিদ্ধান্ত ঢাকায় আনতেই হবে। বজলু মিয়ার বড় শক্তি, তার পাশে একজন ডাক্তার, তিনি বারবার অভয় দিচ্ছেন, ১২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, দ্বিতীয় কোনো স্ট্রোক হইনি, মানে রোগী স্থিতিশীল (স্ট্যাবল)। ডাক্তারের কথায় সাহস দ্বিগুণ হলো, অ্যাম্বুলেন্সে ভাড়া করে রোগী ঢাকায় আনা হলো, তখন রাত ১২টা।

রাতে রোগী ভর্তি করানো, দুঃখের মধ্যে অনেকটা সুখ সংবাদ। বজলু মিয়ার কথায় আর কাজ হলো না, যা করার তা, তার সঙ্গের ডাক্তারই করল। ডাক্তার রাবেকা।

ডাক্তার রাবেকা আর হাসপাতালের ডাক্তার কী করল বজলু মিয়া জানেন না। বজলু মিয়া অসহায়, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। এখানে বজলু মিয়ার ওস্তাদি আর চলে না। এখানে জীবন–মরণ খেলা।

শারীরিক পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা, কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যান, চৌম্বকীয় অনুরণন চিত্র (এমআরআই), ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসকেজি) সবকিছু চোখের নিমেষেই হয়ে গেল।

রোগী হাসপাতালে ভর্তি, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন। বজলু মিয়া হাসেন, তার পরিবার হাসে।

ডাক্তারের হাসি আর চোখে পড়ে না। বজলু মিয়া অনেক অসহায় হয়ে তাকিয়ে ছিলেন ডাক্তারের দিকে, এ যেন তাঁর নিত্যদিনের কাজ।

কিন্তু রোগীর বৃদ্ধা আঙুলের ব্যথাটা থেকেই গেল। অনেক সময়, স্ট্রোকের রোগীর একটা সিম্পটম থেকে যায়, এটাই মেডিকেল সায়েন্স। কিন্তু রোগী বোঝে তার সেই আঙুলের ব্যথা।

বজলু মিয়া অনেকবার ভেবেছেন, ডাক্তারকে আর একবার ধন্যবাদ জানাবে। বজলু মিয়া ভুলে গেছেন।

দেশ আজ ক্লান্তিলগ্নে। আবার বজলু মিয়ার মনে হইছে। করোনা থেকে তাকে বাঁচতে হবে। এটা বড় ছোঁয়াচে রোগ। মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত!

কিন্তু বজলু মিয়া একবারও ভাবেনি, ডাক্তারের কী হবে! ডাক্তার কি বাঁচবে...? সেবিকাদের কী হবে? এ দায়িত্ব কার, জানে না। বজলু মিয়াকে বাঁচতেই হবে। তাই রওনা হয়েছে ডাক্তারের কাছে ...
[email protected]