রাজধানীর বাইরে করোনা রোগীর জন্য ডায়ালাইসিস সেবা নেই

করোনার চিকিৎসায় আইসিইউ বেড। প্রতীকী ছবি।
করোনার চিকিৎসায় আইসিইউ বেড। প্রতীকী ছবি।

করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে আড়াই শর বেশি ভেন্টিলেটর রয়েছে। আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ও জনবল সংকটের কারণে বেশ কিছু ভেন্টিলেটর কাজে আসছে না। জনবলের কমতি আছে আইইসি ইউনিটেও। আর রাজধানীর বাইরে করোনা রোগীর ডায়ালাইসিস সেবাই নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও একাধিক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, করোনা রোগীদের ১৫ শতাংশের তীব্র উপসর্গ দেখা দেয়। ৫ শতাংশ রোগীর পরিস্থিতি থাকে জটিল। এই ২০ শতাংশের অনেকেরই আইসিইউ সেবার পাশাপাশি ভেন্টিলেটর দরকার হয়। আবার করোনার সঙ্গে মারাত্মক কিডনি সমস্যা থাকা রোগীর ডায়ালাইসিস দরকার হয়। আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর ও ডায়ালাইসিস নিয়ে অসন্তুষ্টি এখন অনেকটাই বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে এগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু সমস্যা সহজেই মেটানো সম্ভব।

আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ও ডায়ালাইসিস নিয়ে কিছু সমস্যা আছে বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বা যন্ত্রাংশ না থাকায় সবগুলো আইসিইউ শয্যা বা ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে জনবলের স্বল্পতাও আছে। তবে এসব সমস্যা দূর করার চেষ্টা অব্যাহত আছে।’

নিবিড় পরিচর্যা ও ডায়ালাইসিস

বয়স্ক, করোনার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী অন্য রোগ আছে এমন রোগীদের নিবিড় পরিচর্যা দরকার। নিবিড় পরিচর্যার ক্ষেত্রে শয্যা গুরুত্বপূর্ণ, যা ‘আইসিইউ শয্যা’ নামে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে সারা দেশে করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে শয্যা আছে ১৩ হাজার ৯৮৪টি। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা ৩৯৯টি।

ওই তথ্যে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার করোনা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা আছে ২১৮টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৩৭টি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৮১টি। ১১, ১২ ও ১৩ মে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্যে দেখা যায়, রাজধানীতে গড়ে ১৪৩টি আইসিইউ শয্যা ব্যবহৃত হচ্ছে।

একাধিক করোনা রোগী ও রোগীর আত্মীয় আইসিইউ ওয়ার্ডের সেবা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক দলের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেছেন, আইসিইউ ওয়ার্ডে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় নার্সকে। আইসিইউয়ের নার্সদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার হয়। এই ধরনের নার্স দেশে কম আছে, করোনা হাসপাতালে আরও কম। তারপরও দায়িত্বরতরা ঠিকমতো কাজ করছে কি না তা কেউ নজরদারি করছে না।

করোনা রোগীদের অনেকেই দীর্ঘস্থায়ী কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীর ডায়ালাইসিস দরকার হচ্ছে। গত সপ্তাহে এ ধরনের ৪৭ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে এই সেবা নিচ্ছিলেন। আর করোনা হাসপাতালগুলোতে ডায়ালাইসিস শয্যা আছে মোট ১০৬টি। রাজধানীর বাইরে কোনো করোনা হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের সুযোগ নেই।

ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রেও সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ শোনা গেছে। প্রায় চার ঘণ্টা ঘরে রোগীকে ডায়ালাইসিস নিতে হয়। এই সময় কোনো সমস্যায় পড়লে তৎক্ষণাৎ নার্সের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ইউনিট নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নার্সিং সেবা দেখার দায়িত্ব অন্যদের।’ তিনি স্বাস্থ্য সচিবের (স্বাস্থ্য শিক্ষা ও নার্সিং সেবা) সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। যোগযোগ করলে স্বাস্থ্য সচিব ( স্বাস্থ্য শিক্ষা ও নার্সিং সেবা) আলী নূর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ এখনো কোনো অভিযোগ করেনি।’ তিনি এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দুটি হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান।

ভেন্টিলেটরের ব্যবহার কম

সাধারণভাবে একটি আলোচনা আছে যে, দেশে ভেন্টিলেটর যন্ত্র কম আছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে ভেন্টিলেটর যা আছে, তার অর্ধেকেরও ব্যবহার হচ্ছে না। মারাত্মক রোগীকে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাসে সহায়তা করে এই যন্ত্র। এই যন্ত্রের বিভিন্ন ধরন আছে। একটি যন্ত্র একজনের জন্য ব্যবহৃত হয়। আবার দুজন একটি যন্ত্র ব্যবহার করতে পারে। সূত্র বলছে, বাংলাদেশে একজনের ব্যবহার করা যন্ত্রই বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বলছে, সারা দেশে সরকারি হাসপাতালের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ২৯৮টি ভেন্টিলেটর কেনা হয়েছিল। এর মধ্যে ২৫১টি যন্ত্র করোনা হাসপাতালে বসানো হয়েছে। বাকি ৪৭টি অকেজো অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে পড়ে আছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে ২১টি ভেন্টিলেটর কেনা ছিল। অতিসম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও ২০টি ভেন্টিলেটর কিনেছে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে ৪০০ ভেন্টিলেটর আছে।

প্রথম আলো বিভিন্ন ধরনের রোগীর সেবা নিয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করেছে তাতে দেখা যায় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। মে মাসের তিন দিনের হিসেবে দেখা গেছে বর্তমানে হাসপাতালে থাকা রোগীদের দশমিক ৬ শতাংশ রোগীর ভেন্টিলেটর দরকার হচ্ছে। এর অর্ধেকই পুলিশ হাসপাতালে।

মুগদা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই হাসপাতালে ১৪টি ভেন্টিলেটর আছে। মনিটর না থাকায় ৪টি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ওই হাসপাতালে জনবলেরও সংকট আছে। অন্য একটি হাসপাতালের অর্ধেক যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে না বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, অবেদনবিদেরাই ভেন্টিলেটর ভালোভাবে ব্যবহার করতে জানেন। এই বিশেষায়িত কাজটি তাঁদেরই। দেশে এই ধরনের বিশেষজ্ঞের ঘাটতি আছে। করোনা হাসপাতালগুলোতে ঘাটতি আরও বেশি। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ২৮ এপ্রিলের সভায় এ নিয়ে আলোচনা করে। সভা শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া সুপারিশে তারা বলেছিল, করোনা হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট সংখ্যক অবেদনবিদ নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘দেশে সব সময় অবেদনবিদের ঘাটতি আছে। নতুন নিয়োগ দেওয়া দুই হাজার চিকিৎসকের মধ্য থেকে এই পদে জনবল নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ শহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ব্যবস্থাপনার বিষয়, যা সহজেই মেটানো সম্ভব। দেশে প্রশিক্ষিত অবেদনবিদ আছেন। আইসিইউতে কাজ করা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক আছেন। অনেক হাসপাতালে আইসিইউতে কাজ করা নার্স অনেকটা বেকার বসে আছেন। তাদের এখন করোনা হাসপাতালে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’