জলে ভিজে রাখা বাসী ফুলের মতো

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আগের মতই সূর্য উঠছে-ডুবছে। দূর থেকে পাখিরও ডাক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু জীবনের গতিময়তাকে যেন চেপে ধরেছে। অজানা একটা ভয় মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। কবে স্বাভাবিক হয়ে জীবনের চাকা চলবে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা; নাকি করোনাভাইরাস সেটিও দেখতে দেবে না মনমগজে সেই দুর্ভাবনা বাঁসা বেঁধে নিয়েছে।

গরিব দেশের গরিব মানুষের নানা সমস্যা। মাঠে-ঘাটে, কলকারখানায়, গার্মেন্টসে কাজ করে অধিকাংশ মানুষ দুবেলা-দুমুঠো খাবার মতো একটা অবস্থায় এসে কেবল দাঁড়িয়েছে। অমনি ভাইরাস এসে ধাক্কা মেরে একঘরে করে দিয়েছে। কাউকে চিরতরে নিয়ে যাচ্ছে। কেউবা ভয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়ে, কেউবা অন্য রোগে মারা যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়েছে, তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরাও তাঁর কাছে যাচ্ছে না। এমনকি তাঁর সৎকারও করছে না, বিলাসী গল্পে যেমনটা লিখা ছিল ‘মৃত্যুটা যদিও বা সহে মৃতদেহটা পাঁচ মিনিটের জন্য সইবে না।’ নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় যুবক (নেগেটিভ) অসুস্থ হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও আট-নয় ঘণ্টা দেহটা পড়ে ছিল। কেউ কাছে আসেনি। কত মর্মান্তিক! মা-বোন ওপর তলার ছাদ থেকে ব্যথা বুকে চেপে রেখে দেহটা দেখছিল। তাদের মনে হয়তো নজরুলের লাইনগুলোর মতোই ব্যথা অনুভব হয়েছিল—


‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে

আমার গানের বুলবুলি

করুন চোখে চেয়ে আছে

সাঁজের ঝরা ফুলগুলি।’

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জীবাণু গবেষকেরা বলেছেন, করোনা রোগীর মৃত দেহ থেকে জীবাণু ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আমাদের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, সাংবাদিকেরা আদাজল খেয়ে লেগেছে করোনা থেকে জাতিকে বাঁচাতে। বিলাসী গল্প থেকে বলা যায়, ‘দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, কত ধৈর্য কত সেবা, কত রাত জাগা। খাটিয়া খটিয়া, রাত জাগিয়া জাগিয়া ইহাদের শরীরে আর কিছুই থাকছে না। ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয়ে ভিজাইয়া রাখা বাসী ফুলের মতো, একটু খানি নাড়াচড়া করিতে গেলেই ঝড়িয়ে পড়িবে।’

বর্তমানে তাঁদের সেবা–ভালোবাসা দেখে তাঁদের Terry Pratchett–এর বাক্যটি বলতে চাই, No one is finally dead until the ripples of love they cause in the world die away. (তারা যে ভালোবাসার ঢেউ পৃথিবীতে তৈরি করছে সেগুলো মরে না যাওয়া পর্যন্ত মরবে না।)

যাহোক একদিন ভ্যাকসিন বের হবে, মানুষ মানবতার জয় হবে। কিন্তু গানের কথাগুলো কেন যেন বারে বারে মনে পড়ছে—

‘ওরে মানুষ! কি আছে তোর কর্ম ছাড়া আর?

দেহ, আত্মা তোর কিছু নয় সে তো বিধাতার।

কর্ম যদি ধর্ম নীতি মানে,

তবে আত্মা তোমার পাবে যে ঠাঁই শান্তিরও আশ্রমে।

সময় গেলে নাই যে সময় কিছুই ভাবার।’


শেষের লাইনগুলো সম্মুখ যোদ্ধাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য লেখা। এই সময়ে উৎসাহ তাদের বেশি প্রয়োজন।


*লেখক: শিক্ষক, লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ সৈয়দপুর, নীলফামারী। [email protected] >;