করোনাময় ঈদের গল্প

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

এবারের রমজানে মানুষকে আল্লাহ পুরা ৩০টা রোজার নিয়ামত দান করেছেন। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ডেকেছে মন খুলে। মানুষ যে আজ বড় অসহায়। ডুবন্ত লোক যেমন খড়কুটোর সাহায্যে বাঁচতে চায়, তেমনি করোনাময় এই দিনে মানুষ প্রাণভরে ডেকে যাচ্ছে তার রবকে।
ঈদের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছাবার্তা এসে জমা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমিও ঈদের শুভেচ্ছার সঙ্গে রিপ্লাই দিয়েই যাচ্ছি। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়ে যাচ্ছে।

কর্মসূত্রে ঢাকাতে থাকি। পৃথিবীর এই ক্রান্তিলগ্নে এখন আমি কর্মস্থলে পড়ে রয়েছি। অথচ এখন আমার থাকার কথা ছিল রাজশাহীতে। আব্বা-আম্মা বাড়িতে একা। ভার্চ্যুয়াল লাইফে খুব হাসিখুশি থাকলেও মনটা যে পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও, তা আর বলতে হবে না নিশ্চয়। যা–ই হোক, বাড়িতে আগে থেকেই বারবার বলেছি এবার হয়তো ঈদে যাওয়া হবে না, একেবারে শেষ মুহূর্তে বললে মেনে নিতে কষ্ট হতো, তাই এই ব্যবস্থা। আমি সচেতনতার কারণে রয়ে যাচ্ছি; কিন্তু সবাই তো আর সমানভাবে সচেতন না, আবার সবার হয়তো সেই সক্ষমতাও নেই ঢাকাতে থেকে যাওয়ার।

প্রতিদিন খবরে দেখছি ফেরিতে কিংবা অন্য কোথায় মানুষের ভিড়। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও মানুষের ঘরে ফেরার তাড়া। এরই মাঝে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তবু অনেকেই ফিরে গেছেন নাড়ির টানে। ভয় হয় ফিরে যাওয়া মানুষগুলোর ভিড়ে আমার প্রিয়মুখগুলো ভালো থাকবে তো? মানুষ গ্রামকেই নিরাপদ মনে করছে, সঙ্গে সঙ্গে নিজেরা যে করোনা নিয়ে যাচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা কী আছে? প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন আনন্দদায়ক কিন্তু এবার যে দূরে থাকার গল্পটাই বেশি নিরাপদ। জানি না প্রিয় মুখগুলো কীভাবে এবার ঈদ উদযাপন করছেন, কিন্তু জানি অন্তত আমার থেকে তারা নিরাপদে আছেন।

ঢাকাতে নিজেই রান্নাবান্না করছি, নিশ্চয় করোনা–পরবর্তী সময়ে এই অভিজ্ঞতা বৃথা যাবে না। ঈদের দিন ফজরের পরপরেই আব্বা ফোনে সে কী কান্না। আহ্, পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই কিন্তু বছরের এই দিনে তা কি আর বাঁধ মানে? মনে পড়ে হাজারো মানুষের কথা, যারা বছরের পর বছর শুধু পরিবারের মানুষগুলোর একটু হাসিমুখের জন্য বিদেশে পড়ে থাকেন, যারা দেশের ইমার্জেন্সি সার্ভিসে রয়েছে, তাদের ঈদটাও আজকের আমারই মতো কাটছে নিশ্চয়। তবু প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে ঈদ কাটাতে না পারলেও অনলাইন দুনিয়ার বদৌলতে সামাজিক মাধ্যমে কথা বলে নিচ্ছি, বন্ধুদের সঙ্গে অন্য রকম ঈদ হচ্ছে এবার, সবাই মিলে গ্রুপ কলিংয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করে নিচ্ছি।

আদরের ভাগনিটা এবার সেলামি পাচ্ছে না দেখে মন খারাপ, তাকে খুশি করতে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেওয়ায় সে কী খুশি। থ্যাংক ইউ মামা, থ্যাংক ইউ মামা বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলেছে। এর মাঝেও একটা অনাবিল সুখ আছে, এটাই বা কম কী? অন্তত হাসপাতালের বিছানায় কাটাতে হচ্ছে না। মনে আছে, ২০১৫ সালে এই ঈদটা হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল ফুড পয়জনিংয়ের কারণে ।এই করোনা অন্তত সেটাও মনে করিয়ে দিল।

এবার ঈদে নতুন কোনো পোশাক নেই, পুরোনোগুলোই ধুয়ে দিয়ে সুন্দরমতো ইস্তিরি করে নামাজ পড়ে নিয়েছি। মানুষ যেখানে খেতে পাচ্ছে না, সেখানে নতুন কাপড় শুধুই বিলাসিত। করোনার সঙ্গে সঙ্গে আম্পানের মতো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আজ মানুষ নিরুপায়। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষও নিজেদের দানের হাতকে আরও প্রসারিত করেছে। বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপে মানুষ ফান্ড তৈরি করে দুস্থদের আপ্রাণ সাহায্যের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এটাই তো রমজানের শিক্ষা ছিল। ঈদের আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্যেই যে অনাবিল সুখ, এটাই তো হওয়া উচিত ছিল। করোনা আর আম্পানের মাঝেও অন্তত এটুকু আরও বেশি করে ফিরে এসেছে। তবু এ রকম বন্দী, মুখে মাস্ক পরে, কোলাকুলি, মোসাফা ছাড়া ঈদ সত্যি আমাদের জন্য বেদনাদায়ক।

কাজী নজরুল ইসলামের জয়ন্তী আর ঈদ এবার একসঙ্গে পড়েছে। তাই তো কাজী নজরুলের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ আগে যেভাবে উদযাপন করতাম, সেভাবে উদযাপন করার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতি করছি। হে করুণাময়, করোনা থেকে আমাদের করুণা করো, অন্তত সামনে বেঁচে থাকলে যেন এই করুণ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাই। সামনের ঈদটা যে খুব করে প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে করতে চাই। এই মিনতিটুকু কি খুব বেশি চাওয়া হবে, নিশ্চয়ই নয়।

*লেখক: মো. আসিফ উদ্দীন লিমন, সাবেক শিক্ষার্থী, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]