করোনায় জীবনকে নতুনভাবে দেখা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

কথায় আছে সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। কখনো এই প্রবাদ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ২০তম বছরে এসে হুট করে এই প্রবাদের যথার্থতা নিয়ে বেশ সন্দিহান হতে হয়। স্রোতকে বাধের মধ্যমে মানুষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, সে অনেক দিন হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে করোনা বিপর্যয়ে সময়ও যেন হুট করে থেমে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার ফলও দিয়ে দিয়েছে মাসখানেক আগে। ৩১ মার্চ থিসিস সমাপ্ত করে একজন পূর্ণাঙ্গ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু ওই যে সময়ের হুট করে থেমে যাওয়া, তাই ৩১ মার্চ আজ ও আসেনি।

করোনা বিপর্যয়ে দেশ। বদলে গেছে সবার জীবন যাপনের ধরন। সবাই জীবনকে দেখছে ভিন্নভাবে নতুনরূপে, ব্যতিক্রম নই নিজেও। বাড়ি ছেড়েছিলাম ১০ বছর আগে। যাওয়ার সময় মা বলেছিলেন এই বের হয়ে যাওয়াই একধরনের শেষ যাওয়া, কারণ আর কখনো স্থায়ীভাবে ফেরা হবে না। কথার গভীরতা বুঝিনি, ১০ বছরে কখনো টানা ১ মাস বাড়িতে থাকা হয়নি। এখন এই বাড়িতে বসে সেই কথার মর্মার্থ টের পাই। ১৯ মার্চ বাড়ি আসি। ভেবেছিলাম ১৪ দিন পরেই ফেরত যাব। সময় থেমে যাওয়ায় সেই ১৪ দিন শেষ হচ্ছে না এখনো। কর্মহীন অফুরন্ত সময় পাওয়ায় এখন চিন্তাভাবনা অধ্যাত্মিক লেভেলে চলে গেছে।

চিন্তা করি, এখন আমার কই থাকার কথা ছিল? কুমিল্লা থেকে ঢাকায় শিফট হওয়া, চাকরির সন্ধানে নামা আরও কতশত প্ল্যান। এত দিনে হয়তো কোনো না কোনো চাকরি হয়েই যেত অথবা বেকার তকমা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম এক অফিস থেকে অন্য অফিসে। কিন্তু হঠাৎ করে পাওয়া এই অফুরন্ত সময় জীবনকে নতুনভাবে দেখা শিখিয়েছে।

মানুষের জীবনে সুখী হয়ে বেচে থাকাটা কি খুব কঠিন কোনো কাজ? নাকি সহজ জীবনকে কঠিন করে ফেলছি আমরাই? খুব কঠিন একটা প্রশ্ন। পাঁচ মাস আগে বাবা মারা যান। সংসারের বড় ছেলে হিসেবে সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হয় হুট করেই। তার আগে তো বাউন্ডুলে হয়েই কাটিয়েছি জীবন। তারপরও শোক কাটিয়ে আবার পরিবার থেকে দূরে চলে যাওয়ায় সাংসারিক কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। এই কোয়ারেন্টিনে বাড়িতে থাকায় এখন বাজার করতে হয় নিয়মিতই। এ ছাড়া রয়েছে আরও অনেক ধরনের বিষয় যা আগে জানাই ছিল না। সবকিছু মিলিয়ে মনে হয় আসলে মানুষের জীবন খুবই সহজ। সেই সহজ জীবনকে আমরা কঠিন করে তুলেছি সামাজিক স্ট্যাটাস নামক মানদণ্ড তৈরি করে। এই যে চার বছর কষ্ট করে ১৬২ ক্রেডিট সম্পন্ন করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া, কেন? চিন্তা করি। একটা ভালো চাকরি? উচ্চ স্কেলের বেতন? ইঞ্জিনিয়ার টাইটেল? হয়তো সবগুলাই। অথচ নিজেদের যেই পরিমাণ জমি আছে, নিজে সেইগুলা ঠিকভাবে ব্যবহার করলে, চাষাবাদ করলে চাকরিতে যে বেতন পাওয়া সম্ভব তার চেয়ে তিন–চার গুণ বেশি টাকা আয় করা সম্ভব। কিন্তু ওই যে সামাজিক স্ট্যাটাস, সমাজে একজন কৃষক সে শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, আমরা তাকে লোয়ার ক্লাসের হিসেবে রেখে দিছি। আর একজন ইঞ্জিনিয়ার, তাকে আমরা সব বিচারেই প্রথম শ্রেণিতে রেখে দিয়েছি। সুতরাং আমরা প্রথম শ্রেণিতেই থাকতে চাইব, সেটাই স্বাভাবিক।

চার বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা, তাই অনেকটা অভ্যস্তই হয়ে গেছিলাম। হলের পরিবেশ কী রকম, তা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের শিক্ষার্থী বলতে পারবেন, সব সময় একটা উৎসব উৎসব ভাব। টানা চার বছর ২০০ মানুষের সঙ্গে একত্রে থাকার পর হুট করে ভিন্ন লাইফস্টাইলে চলে আসাটা কষ্টকরই। আবার ব্যাপারটা ইতিবাচকভাবেও দেখা যায়। অনেক দিন যেহেতু পরিবারকে সময় দেওয়া হয় না, তাই প্রকৃতিই হয়তো সবাইকে সেটা করতে বাধ্য করেছে।

আমরা বাঙালি, আমরা একটা বিষয় নিয়ে বেশি দিন থাকতে পারি না। আমরা স্ট্যাটিক নয়, আমরা ডায়নামিক। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের ডায়নামিক লাইফস্টাইল স্ট্যাটিক হয়ে গেছে ফলে নিরাসক্ত হয়ে গেছি। প্রথম প্রথম প্রতিদিন কতজন আক্রান্ত হয়েছে সেই খবরের জন্য উৎসুক হয়ে থাকলেও এখন সেটা জানতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। আমাদের জীবনে এতই তালগোল লেগেছে যে আজ কী বার, সেটাও তালগোল পাকিয়ে ফেলছি, হুটহাট দেখি শুক্রবার চলে আসছে। আমরা এ রকম জীবন চাই না, আমরা আবার আগের মতো হয়ে যেতে চাই। টং দোকানে চা খেতে চাই, বাংলাদেশের খেলায় মিছিল করতে চাই, জীবনযুদ্ধে দৌড়াতে চাই।

*লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা সেনানিবাস, কুমিল্লা। [email protected]