স্বপ্ন দেখছি সেই পৃথিবীর

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

হঠাৎ একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শুনব আবিষ্কার হয়ে গেছে করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন। যেই ভ্যাক্সিনটি কোনো দেহে একবার প্রবেশ করালে সেই দেহটি আর কখনো আক্রান্ত হবে না কোভিড-১৯–এ। যেই ভ্যাক্সিনটি করোনাভাইরাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে তামাম বিশ্বে। লাখো মানুষ সুস্থ হতে শুরু করেছে।

আসলে সেদিন কী হবে? বিশ্বের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে হাততালি দিয়ে প্রশংসিত করবে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে। তালু প্রসারিত করে কপালের কাছে তুলে স্যালুট জানাবে বিশ্বের সব প্রান্তের চিকিৎসক-নার্সদের। গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে প্রণাম জানাবে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারকদের।

একদিন নির্মূল হবে করোনাভাইরাস। সেদিন, ক্রিকেটাররা ব্যাট-বল হাতে নেমে পড়বে সবুজ ঘাসের মাটিতে। শুরু হবে আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেটের সব আয়োজন। লোকে লোকারণ্য হবে মিরপুর স্টেডিয়াম, মেলবোর্ন, আবুধাবি, ইডেন গার্ডেনের পুরো গ্যালারি। দর্শকেরা লাফিয়ে উঠবে প্রিয় ক্রিকেটারের হাঁকানো সুবিশাল ছক্কায়। উইকেট হারানোর টেনশনে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কিছু জনতা। বাসায় বসে টিভির সামনে ওঁত পেতে থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীরা। একটি জয়ের প্রতীক্ষায়। জয় পেয়ে গেলে সেই আনন্দে রাজপথে মিছিল শুরু হবে। স্লোগানে মুখরিত হবে আকাশ–বাতাস।

একদিন নির্মূল হবে করোনা। সেদিন খুলে দেওয়া হবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালা। দপ্তরি সেদিন ছুটে আসবে চাবি নিয়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভরে উঠবে শিক্ষার্থীদের পদচারণে। শিক্ষার্থীরা ফিরে পাবে তাদের স্মৃতিবিজড়িত ভালোবাসার ক্যাম্পাস। পাঠদানের শুরুতে শিক্ষক–শিক্ষিকারা শোনাবেন তাঁদের ‘করোনা-কালের জীবনগাথা’। তুলে ধরবেন বিচিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনা। শোনাবেন তাঁদের লকডাউন জীবনের বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ক্লাসের ফাঁকে গল্পের আসরে বসবে বন্ধুবান্ধবেরা। সেই গল্পের কোনোটি সাদামাটা আবার কোনোটি রোমহর্ষ-গাম্ভীর্যে ভরা।

একদিন বিশ্ব থেকে নির্মূল হবে করোনাভাইরাস। রোজগারের পথ খুলে যাবে সব অভিভাবকের। ময়দানে নেমে পড়বে উপার্জনের তাগিদে। সেদিন খুলে দেওয়া হবে দেশের সব অফিস-আদালত, দোকানপাট। ভ্যান, রিকশা, অটোরিকশা, বাস, ট্রাক ইত্যাদি যাবতীয় যানবাহন নিয়ে চালকেরা বের হবেন রাস্তায়। শহর ফিরে পাবে আপন প্রাণ; কৃত্রিম কোলাহল। পার্ক, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর কানায় কানায় পরিপূর্ণ হবে লোকসমাগমে। পাল্টে যাবে গ্রামগঞ্জের চিত্রও। আগের মতোই হাটবাজার বসতে শুরু করবে নদীর ধারে, বটতলার ছায়ায়। আগের মতোই মোড়ের দোকানে চায়ের আড্ডা হবে। শুরু হবে মিনি পার্লামেন্টের আলাপ-আলোচনা।

সেদিন ত্রাণ-সাহায্যের জন্য কারও মুখ চেয়ে থাকতে হবে না কোনো অসহায় দিনমজুরকে। নিজের রোজগারের টাকা বুক-পকেটে নিয়ে উৎফুল্লচিত্তে বাসায় ফিরবেন। নিজের পরিশ্রমের টাকার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। তারপর মনে মনে বলবে, ‘এত দিন কোথায় ছিলি হতচ্ছাড়া? আমাকে অন্যের কাছে হাত পাততে...(বলতে বলতে কেঁদে ফেলবে)।

সেদিন অফিসে কাজের ফাঁকে সহকর্মীদের সঙ্গে জমানো গল্প কতখানি দীর্ঘ হবে, আমার জানা নেই। হল–মেসে ফিরে কত শিক্ষার্থী তাঁর বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেলবেন, সেই পরিসংখ্যানও আমার জানা নেই। জানা নেই, সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধুদের আড্ডায় চায়ের কাপে ঝড়ের গতি ঘণ্টায় কত কিলোমিটার হবে।

আমি খুব মিস করছি আমার বন্ধুদের। মিস করছি তাদের যারা শেষবার বিদায় নেওয়ার সময় বলেছিল, ‘যদি এই মহামারিতে টিকে থাকতে পারি, তবে আবার দেখা হবে।’ সেদিন আমি তাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলব, ‘দ্যাখ বন্ধু, আমরা এই মহামারিতে টিকে গেছি। আমরা মরি নাই।’


লেখক: এইচএসসি পরীক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী। [email protected]