অন্য রকম ঈদ

ঈদ আসে খুশির জোয়ার আর আনন্দের বান নিয়ে। সেই উচ্ছলতা অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যে চলা কিছু মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে যায় অন্যভাবে। সেই অনুভূতির কথা জানাতে তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে আমাদের এবারের ঈদ আয়োজন:

মনির হোসেন
মনির হোসেন

মনির হোসেন
‘আমাগো জীবনে আবার ঈদ কী! ঈদ আর অন্যান্য দিনের মইদ্যে কোনো তফাত খুঁইজা পাই না!’
এ কথা বলে হতাশা ঝাড়েন ফুটপাতে শুয়ে থাকা মনির হোসেন। দিন-রাতে এভাবে একঠায় তাঁকে শুয়েই থাকতে হয়। কারণ তাঁর দুই পা নেই।
রাজধানীর ফার্মগেটে আনন্দ হলসংলগ্ন পদসেতুর পাশে, ফুটপাতে পড়ে থাকেন শারীরিক প্রতিবন্ধী এই যুবক। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একঠায় পড়ে থাকেন থালা নিয়ে। প্রত্যাশা একটাই—দয়া করে যদি কেউ কিছু দেন। মনিরের (৩২) বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরে।
১৬ বছর বয়সে ট্রেন দুর্ঘটনায় পা হারান মনির। সেই থেকে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। মনিরের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়জন। থাকেন রাজধানীর বেগুনবাড়ি বস্তিতে। ভিক্ষা করে প্রতিদিন চার-পাঁচ শ টাকা পান। তা দিয়ে সংসার চলে।
এবারের ঈদ বরাবরের মতো ঢাকায়ই করবেন বলে জানান মনির। অন্যান্য দিনের মতো একইভাবে পড়ে থাকবেন ফুটপাতে। দেখবেন নতুন পোশাক পরা মানুষের আনন্দ। কেউ কিছু দিলে খুশি মনে নেবেন। দোয়া করবেন তাঁর জন্য। এভাবে কেটে যাবে ঈদ।
আব্দুল মোতালেব

আব্দুল মোতালেব
আব্দুল মোতালেব


‘দেশে (গ্রামে) বাড়ি নাই, ঘর নাই, কই যাবো রে, ভাই!’
আব্দুল মোতালেবের এ কথায় এক ধরনের ব্যাকুলতা ফুটে ওঠে। ৫৫ বছর বয়সী এই প্রৌঢ়ের এক পা নেই। আরেক পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দুই হাতে ভর দিয়ে বেয়ারিংয়ের চাকা লাগানো গাড়িতে চলাফেরা করেন তিনি। বাংলামোটরের পদসেতুর ওপর ভিক্ষা করেন।
আট বছর আগে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে রিকশা চালাতেন তিনি। ট্রাকের ধাক্কায় আহত হয়ে পা হারিয়েছেন।
কিছু জমিজিরাত যাওবা ছিল, চিকিত্সা করাতে গিয়ে সব খুইয়েছেন। এখন অন্যের দয়ায় জীবন চলছে। ঈদ অবশ্যই একটি আনন্দের দিন বলে জানান মোতালেব। তবে তাঁর আনন্দটা অন্যখানে। এই দিন মানুষ খুশি হয়ে কিছু টাকা বেশিই দেন। এ টাকা দিয়ে আপনজনদের জন্য কিছু কেনাকাটা করেন মোতালেব। তখন আনন্দে ভরে ওঠে তাঁদের মন। তা দেখে মোতালেবের মনটাও আনন্দে ভরে যায়।

আবুল কালাম
আবুল কালাম

আবুল কালাম
ঈদটা ঢাকাতেই কাটাবেন আবুল কালাম। জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের পাশে হাইকোর্টের সামনে বটতলায় বসে অন্যের অনুগ্রহ কামনায় করে দিন গুজরান করেন তিনি। তাই ঈদের দিন যখন ঈদগাহের জামাতে মুসল্লিদের ঢল নামে তাঁর আয়টাও বেশ বেড়ে যায়।
তবে ঈদের দিন এই বাড়তি আয়ই একমাত্র লক্ষ্য নয় বলে জানান ৪০ বছর বয়সী কালাম। শৈশবে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে পা দুটো অকেজো হয়ে গেছে তাঁর। এ জন্য নামাজ আদায় করার মতো সামর্থ্য নেই।
কালাম জানান, ঈদের দিন হাজারো মুসলিমের নামাজ আদায় দেখে এক ধরনের প্রশান্তিতে মনটা ভরে যায়।
ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে কালামের বাড়ি। অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যে সেখানেই দিন কাটে তাঁর। রমজান মাসে ঢাকায় আসেন। এখানে নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আরে বাই, যেহানে রাইত, সেহানেই কাইত।’
ঈদের পর আরও কয়েকটা দিন থেকে ফিরে যান নিজ ঠিকানায়। সেখানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার আছে তাঁর।
মো. খায়রুল ইসলাম
ঈদ খায়রুল ইসলামের জীবনে বিরাট এক প্রত্যাশা। ঈদে মানুষ খুশি হয়ে দান-দক্ষিণা একটু বেশিই করেন। এতে খায়রুলের (২৭) বাড়তি আয় হয়। তা পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটায়।

মাত্র ১৫ মাস বয়সে অজ্ঞাত এক রোগে খায়রুলের শরীরের নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে যায়। বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওই অংশটুকু বাড়েনি। এখন তাঁর হাত দুটোই চলাফেলার অবলম্বন। তাঁর বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলায়। এখন নারায়ণগঞ্জ শহরে চেয়েচিন্তে জীবিকা চালান। গড়ে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়। থাকেন একটি কাঠের মার্কেটের ভেতর এক রিকশার গ্যারেজে।

ঈদের সময় ঈদগাহের পাশে দাঁড়ালে অনেক টাকা আসে। এ টাকা নিয়ে দুদিন পর গ্রামে যাবেন তিনি। বাবা-মা ও ভাইবোন মিলিয়ে ছয়জনের সংসার তাঁর। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও এই সংসারে অনেকটা খরচ জোগাতে পেরে তিনি তৃপ্ত।

সাইদুল ইসলাম 

সাইদুল ইসলাম
সাইদুল ইসলাম


ঈদে আনন্দ করার সময় নেই সাইদুল ইসলামের। লোকজনের দান গ্রহণ আর দোয়া করতে করতেই দিন কেটে যায়। আয় উন্নতি ভালো হয় বলে ঈদে আনন্দের বিষয়টি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাঁর।
রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ট্রেড সেন্টারের সামনের রাস্তায় পড়ে থাকেন সাইদুল (৪০)। নয় বছর আগে ট্রেনে এক পা কাটা পড়ার পর থেকে জীবিকার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভিক্ষা। রোজ ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয় বলে তিনি জানান।
সাইদুলের গ্রামের বাড়ি বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার হালালিয়া গ্রামে। অন্যের দয়ায় রুজি-রোজগার ভালো হয় বলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন ঢাকায়। যাত্রাবাড়ীতে মাসে  তিন হাজার টাকায় একটি বাসা ভাড়া করে থাকছেন সপরিবারে।
সাইদুলের পরিবারের সদস্যরা এবার যে যাঁর মতো করে ঈদ উদযাপন করবেন। তিনি প্রতিদিনের মতো ভোর ছয়টার দিকে রিকশাযোগে যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান হলের সামনে গিয়ে বসে যাবেন ভিক্ষায়। রোদবৃষ্টি যা-ই থাকুক, কোনো পরোয়া নেই।

সোহেল খান
সোহেল খান

সোহেল খান
১৫ বছর ভারতে ছিলেন সোহেল খান। এ দাবি করে তিনি বলেন, দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, কাশ্মীরসহ ১০টা বড় শহরে ঘুরেছেন। এ জন্য তাঁর ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। কথায় কথায় হিন্দি বলেন। চেয়েচিন্তে পরের অনুগ্রহে দিন গুজরান করলেও হাবভাবে বিজ্ঞের ভাবটা স্পষ্ট।
ঈদে তাঁর বিশেষ চাওয়া একটাই—পকেটভর্তি টাকা। হোক না পরের দান, কুছ পুরোয়া নেই। ঈদ শেষে পরিবারের স্বজনদের কাছে এ টাকা নিয়ে যাওয়ার পর শুরু হবে তাঁর আনন্দ।
গুলিস্তানে বিলুপ্ত সিনেমা হলের কাছে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় রোজ দেখা মিলবে সোহেল খানের (৩২)। ছয় বছর আগে টাইফয়েডে সোহেলের হাত-পা সব শুকিয়ে যায় সেই থেকে তিনি অনেকটা জীবন্ত কঙ্কাল। প্রতিদিন সকাল সাতটার দিকে সোহেলের বড় ভাই তাঁদের খিলক্ষেতের বাসা থেকে ভিক্ষা করতে দিয়ে যান। রাত ১০টার দিকে আবার তাঁকে নিয়ে যান ।
চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় তিনি। কাপড়ের ব্যবসায়ী বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন।
সোহেলের মা-বাবা সাভারে থাকেন। তিনি বলেন, ভিক্ষা থেকে আয়ের বড় অংশ মা-বাবাকে দিয়ে দেন। অন্য ভাইয়েরাও ভিক্ষার টাকার একটা অংশ নেন।

প্রতিদিন গড়ে ৭০০-৮০০ টাকা করে পান। রমজান আর ঈদের সময় এই অঙ্ক হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। 

সোহেলের গ্রামের বাড়ি জেলা ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম সাঈদ মিয়া। ঈদের সময় ভালো আয় হয়। তাই ঈদের পরে মা-বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যাবেন।

শাহজুল

শাহজুল ঈদের দিন সকালটা কাটাবেন ঢাকায়। এরপর রওনা দেবেন বাড়ির উদ্দেশে। তাঁর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের ঢাকেশ্বরীতে। সেখানে তিন সন্তান নিয়ে শাহজুলের স্ত্রী থাকেন।

গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ মার্কেটের সামনে বসে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভিক্ষা করেন তিনি। প্রতিদিন গড়ে ৫০০-৬০০ টাকা করে পান। রমজান মাসে প্রতিদিন এই আয়ের গড় হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

শাহজুলের (৪৫) ভাষ্য, আগে রিকশাভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন তিনি। ২০০৭ সালে কালাজ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। পায়ে পচন ধরায় দুটি পা-ই হাঁটু থেকে কেটে ফেলতে হয়। সেই থেকে তাঁর জীবন চলছে পরের দয়ায়। তবে আগের চেয়ে এখন রোজগার বেশি বলে জানান শাহজুল।