কফিনে বন্দী ঈদের আনন্দ

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ১৩ পুলিশ সদস্য। এ পর্যন্ত ১৪ পুলিশ সদস্য করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে চার হাজার। ছবি: সংগৃহীত
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ১৩ পুলিশ সদস্য। এ পর্যন্ত ১৪ পুলিশ সদস্য করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে চার হাজার। ছবি: সংগৃহীত

ঈদের সকালে পাঁচ বছরের সামিকে পাঞ্জাবি পরিয়ে কবরস্থানে পাঠিয়েছিলেন মা মুন্নি আক্তার। বলেছিলেন, বাবা ঘুমিয়ে আছেন ওখানে। কবরস্থান থেকে ফিরে আসার পর সামি জানায়, কফিনবন্দী বাবাকে সে দেখতে চায়। কখনো কাঁদে, কখনো জেদ ধরে। মুন্নি ভাবতেও পারেননি তাঁকে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

আবদুল্লাহ আল সামি কনস্টেবল জসিমউদ্দীনের ছেলে। পুলিশ বাহিনীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রাণ হারানো প্রথম সদস্য। এ পর্যন্ত জসিমউদ্দীনসহ এই বাহিনী হারিয়েছে তার ১৪ সদস্যকে। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে চার হাজার।

করোনাভাইরাসে প্রাণ হারানো এই মানুষগুলোর স্বজনদের কাছে ঈদ এসেছে কফিনবন্দী হয়ে। আজ মঙ্গলবার এমন চারটি পরিবারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামের ছেলে জসিমউদ্দীন। তিনি কর্মরত ছিলেন ঢাকার ওয়ারী থানায়। গত ২৪ এপ্রিল প্রথম উপসর্গ দেখা দেয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চার দিনের মাথায় ২৮ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে মারা যান জসিমউদ্দীন।

ওই দিন সন্ধ্যায় স্ত্রী-সন্তান কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করেছিলেন। যাওয়া হয়নি। পরদিন অ্যাম্বুলেন্সে কফিনবন্দী হয়ে বাড়ি ফেরেন জসিম।

জসিমের স্ত্রী মুন্নি আক্তার বলেন, ‘যেদিন ও মারা যায়, সেদিন ইফতারের পরও আমার শাশুড়ির সঙ্গে কথা হয়েছে। এরপর আর ফোন তোলেনি। রাত ১০টায় খবর পেলাম, নাই আর।’ গ্রামের বাড়িতে লাশ দাফনের সুযোগ পেলেও স্ত্রী-সন্তানেরা মুখ দেখার সুযোগ পাননি।

ঈদের দিন সকালে সামি এক স্বজনের সঙ্গে কবরস্থানে গিয়েছিল। মুন্নি বলছিলেন, ‘মাটি সরে যাওয়ায় কফিনের একটা অংশ বেরিয়ে এসেছে। সামি মনে করেছে ঢাকনাটা সরালেই বাবাকে দেখা যাবে।’

দুই মেয়ে এক ছেলের জনক জালালউদ্দিন খোকার পাঁচ বছরের ছেলে বুঝে উঠতে পারছে না, বাবা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ৯ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

জালালউদ্দিনের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, রাজারবাগ থেকে ঈদের বাজার করে পাঠিয়েছিল, খাবারদাবার ও কাপড়চোপড়। ছেলে সামিউল আরাফাতকে এক স্বজনের সঙ্গে কবর জিয়ারত করতে পাঠিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে সারা দিন। বাবা কেন ফোন করছেন না, কেন তাঁকে আর দেখা যাচ্ছেন না, এমন হাজারো প্রশ্নে সে অস্থির করে রেখেছে পরিবারের সবাইকে।

গত ২৬ এপ্রিল শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল জালালউদ্দিনের। জ্বর ছিল সামান্যই, এই জ্বরে স্বামী মারা যাবেন, এখনো ভাবতে পারেন না সাবিনা ইয়াসমিন। পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তা করবেন বলে শরীর এতটা খারাপ, খুলে বলেননি। তাঁরা বুঝতে পারেন ৭ মে। সেদিন থেকে আর ফোন ধরেননি জালালউদ্দিন। ময়মনসিংহের ভালুকায় দুদিন পর অ্যাম্বুলেন্সে পৌঁছায় তাঁর মৃতদেহ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক (উত্তর) বিভাগের সদস্য আশেক মাহমুদ (৪২) সব সময় ছুটি পেতেন না। কিন্তু স্ত্রী মমতাজ বেগমের সঙ্গে ২৩ বছরের সংসারজীবনে ঈদের দিন চোখের দেখা হয়নি, এমনটা হয়নি কখনো। কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও পরিবারকে জামালপুরের মেলান্দহের ইন্দ্রবাড়ি গ্রামের বাড়ি এসেছেন। দুই ছেলের সঙ্গে ঈদ করে ফিরে গেছেন রাজারবাগে ট্রাফিক ব্যারাকের তৃতীয় তলায়। ২৯ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শাহীন মাহমুদ ও অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া নাইমুল মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে আশেক মাহমুদের স্ত্রী মমতাজ বেগম ঈদের দিন পার করেছেন কেঁদে। স্বামী হারানোর শোক তো আছেই, ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও আছেন গভীর শঙ্কায়। বড় ছেলে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে এবার।

মমতাজ বেগম বলেন, ‘ছেলেটা অনেক লেখাপড়া করে বড় কিছু হোক চাইত ওর আব্বা। বেঁচে থাকলে হয়তো যেভাবে হোক ব্যবস্থা করত। এখন কী হবে জানি না।’

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের পরিদর্শক রাজু আহম্মেদ ফেসবুকে সাত বছরের মেয়ে জানিতা সামিনের সঙ্গে ছবি পোস্ট করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘আমার একমাত্র রাজকন্যা।’ প্লাজমাও দেওয়া হয়েছিল রাজুকে। তাও বাঁচানো যায়নি।

রাজু আহম্মেদের ভাই রাশেদ আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ১৩ বছরের ছেলে ফারহান আহম্মেদ আর মেয়েকে নিয়ে সুখে ছিলেন রাজু। মেয়ে ছিল চোখের মণি। আক্রান্ত হওয়ার পরও ভিডিও কলে দিনে দুই-তিনবার কথা বলেছেন। এমনকি অক্সিজেন দেওয়ার পরও কথা বলেছেন। তবে ভেন্টিলেশনে দেওয়ার পর আর কথা হয়নি।

ঢাকার যাত্রাবাড়িতে তিন ভাই, মা মনোয়ারা বেগম ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যে বাড়িতে রাজু আহম্মেদ থাকতেন, ঈদের আগের দিন এই বাড়ির সামনে এসেই দাঁড়ায় রাজু আহম্মেদের কফিন।

রাশেদ বলেন, ফারহান বুঝতে পারলেও, পুরো পরিবারের চেষ্টা ছিল ঈদের দিন মেয়েটাকে ভুলিয়ে রাখা।

তিনি বলেন, ‘এবার কি আমাদের আর ঈদ আছে? মেয়েটা মৃত্যু কি বোঝে না। সকালে উঠেই ভাস্তিকে নতুন কাপড় পরানো হয়েছে। বাবা কোথাও না কোথাও আছে বোঝানো হয়েছে। কত দিন আর এভাবে বুঝ দেওয়া যাবে?’