আম্পান পরবর্তী জোয়ার-ভাটায় শ্যামনগর-আশাশুনিতে চরম দুর্ভোগ

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভাঙায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত লোকালয়। ঝাপা এলাকা, পদ্মপকুর ইউনিয়ন, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা, ২৭ মে। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভাঙায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত লোকালয়। ঝাপা এলাকা, পদ্মপকুর ইউনিয়ন, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা, ২৭ মে। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর ও আশাশুনির শতাধিক গ্রামে খেলছে জোয়ার-ভাটা। এ দুই উপজেলায় চারটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী ও গৃহহীন।

সরকারিভাবে উপকূলের বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ না থাকায় বাড়িঘরে ফেরার আশায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণে নেমেছে সাতক্ষীরার উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের হানায় পড়ে গেছে হাজার হাজার গাছ। জলোচ্ছ্বাসে ধসে পড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ও গ্রামবাসীর কাঁচা ঘরবাড়ি। ভেসে গেছে চিংড়ি ঘের ও মাঠের ফসল। সবকিছু হারানো উপকূলবাসী বেঁচে থাকার সংগ্রামের নেমেছে। আম্পান পরবর্তী জোয়ার-ভাটায় উপকূলবাসীর জীবনে নেমে এসেছে দুর্দশা। তাঁদের দাবি, 'ত্রাণ নয়, টেকসই বাঁধ চাই।'

সরেজমিনে দেখা যায়, ঈদের পরের দিন সকাল থেকে কয়েক হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে উপকূলীয় বাঁধনির্মাণ কাজে নেমেছে। শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপকুর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া বাঁধ রক্ষায় কাজ করছে হাজার-হাজার গ্রামবাসী। তাঁরা ভাটার সময় কাজ করছেন, আর জোয়ারে সময় কাজ বন্ধ রাখছেন। আজ বুধবার ভোর থেকে বাঁধের কাজে তাঁদের ব্যস্ত দেখা গেল। আবহাওয়া তেমন ভালো না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে হালকা বাতাস বইছে ভোর থেকেই। এখনো প্রতিদিন জোয়ার-ভাটার কারণে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে, রাস্তার ওপর ও নৌকায় বসবাস করছেন।

গাবুরা ইউনিয়নের নেবুবনিয়া ভেঙে যাওয়া বাঁধ বাঁধার চেষ্টা করছে গ্রামবাসী। নেবুবুনিয়া গ্রামের মো. ছাত্তার গাজী ও মো. নূরুল হক হাজী জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেবুবুনিয়া এলাকার বাঁধ ভেঙে গোটা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের সময় ৮-১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। আবার ভাটার সময় পানি নেমে যায়। জোয়ার-ভাটায় তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

পদ্মপকুর ইউনিয়নের আবদুল হামিদ জানান, ইউনিয়নের ৮৫ ভাগ জমিতে চিংড়ি হয়। কোটি কোটি টাকার চিংড়ি ভেসে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে রিং বাঁধ দিয়ে পানি লোকালয়ে ঢোকা বন্ধের চেষ্টা চলছে। গ্রামের হাজার দেড়েক মানুষ বাঁধ বাঁধার কাজ করছে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ মেরামতের কাজ করছে এলাকাবাসী। উপকূলীয় এলাকা, প্রতাপনগর ইউনিয়ন, আশাশুনি, সাতক্ষীরা, ২৬ মে। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ মেরামতের কাজ করছে এলাকাবাসী। উপকূলীয় এলাকা, প্রতাপনগর ইউনিয়ন, আশাশুনি, সাতক্ষীরা, ২৬ মে। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি

আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেঙে যাওয়া বাঁধ মঙ্গলবার থেকে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নির্মাণকাজ চলছে বলে জানান হাজরাখালি গ্রামের আবদুল কাদের।

শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল আলম বলেন, বাঁধ রক্ষায় গ্রামবাসীকে নিয়ে কাজ করছেন। মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর তাঁদের সহায়-সম্বল নির্ভর করে।
মঙ্গলবার থেকে গ্রামবাসীদের নিয়ে রিং বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ করা চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল। তিনি বলেন, ১২ হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। ২২ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ইউনিয়নের ৯০ ভাগ পানির নিচে। কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর ১৫ স্থানে বাঁধ ভেঙে ইউনিয়নের ২৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী। এক সপ্তাহ ধরে রিং বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আটটি স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ মেরামত সম্ভব হবে না।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকাবাসী কাজ করছে। তাঁরা সিনথেটিক ব্যাগ সরবরাহ করছেন। এ ছাড়া কিছু জিও ব্যাগও দেওয়া হবে। এলাকাবাসী যে বাঁধটি দিচ্ছে তা দিয়ে লোকালয়ে সাময়িক পানি ঢোকা বন্ধ করা যাবে। ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।

গ্রামবাসীর সহযোগিতায় বাঁধ রক্ষার কাজ চলছে। উপকূলে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার বাঁধ ধসে গেছে ৫৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। লক্ষাধিক মানুষ এসব বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। ৮৪ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ রক্ষার কাজ শুরু করেছে গ্রামবাসী। দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।