করোনা, ঈদ ও ঈদ-পরবর্তী ভাবনা

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা, কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য ছোট ফ্ল্যাটে গাদাগাদি করে থাকি। ঈদ মানেই অফিস থেকে বেতনের বাইরে কিছু বাড়তি (বোনাস) টাকা পাওয়ার আনন্দ আর প্রচণ্ড ভিড় সত্ত্বেও বাড়ি ফেরার আনন্দ আসলে ঈদেই। সকালে মায়ের হাতের সেমাই, ভাইবোনদের ঈদ সেলামি, স্কুলজীবনের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। এই ঈদে এসব কিছুই ছিল না।
করোনা বাস্তবতা এবার এক অন্য রকম ঈদের দিন দেখিয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই মিষ্টিজাতীয় কিছু রান্না। তাড়াহুড়া করে গোসল। নাশতা করেই নামাজের জন্য দৌড়। বাসায় এসে আবার রান্না। এই কদিনে বুঝে গেছি আমাদের মা, বোনদের কতটা পরিশ্রম করতে হয় রান্নাঘরে।

দুই মাস থেকে একা থাকার সুবাদে জানাই ছিল খুব একাকিত্ব মাখানো ঈদ কাটবে এবার। এই জাদুর শহরে প্রতিবেশী হিসেবেও কেউ আপনার খোঁজ নিতে আসবে না। এই অভিজ্ঞতা আরও চার বছর আগেই হয়েছিল, যখন এ শহরে প্রথম ঈদে ছিলাম। এবার পরিস্থিতি একেবারে আলাদা, আগেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম, তাই কঠিন মনে হয়নি। শুধু চাঁদরাত থেকে পরের দিন সন্ধ্যা অবধি কিছু বখে যাওয়া ছেলের আতশবাজি আর পটকা কানে বিঁধেছে।

স্বভাবতই ঈদের দিনে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের খুঁজে নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল একমাত্র ভরসা। তাই একটু বেশি সময় কাঁটাতে হয়েছে সেখানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক দিক, ভয়, ঘটনার অতিরঞ্জিত প্রকাশ আর ফেক নিউজের মাঝে নিজেকে এক মহাবিপদের সমুদ্রে আবিষ্কার করলাম বস্তুত আমরা তো ভালো আছি, অনেক ভালোই আছি।

হ্যাঁ, ঈদের এই দিনগুলোতে কিছু ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক মারা গেছেন, যা দেখে সাধারণ মানুষ বিচলিত হতেই পারেন। কিন্তু জীবনের এই সময়ে আপনি ভয় বা বিচলিত হলেন তো হেরে গেলেন।
এই মহামারির মধ্যে চীন হংকং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন আইন চালু করেছে। জর্ডান, ইয়েমেন, ইরান, ওমানসহ আরও কিছু দেশে নিউজপেপার ব্যান করে দেওয়া হয়েছে। এর কারণ দেখানো হয়েছে পেপার থেকে কোভিড-১৯ ছড়ায়। যে ব্যাখ্যার কোনো ভিত্তি নেই।

ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রীকে এক গোপন ভিডিওতে বলতে দেখা গেছে যে, ‘Now that the media is only talking about Covid-19, we need to use this moment of calm to change all the rules.’

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

৮৪টা দেশে এখন জরুরি অবস্থা কার্যকর আছে। কোনো রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী কেউ কিছুই বলছে না। সব দেশের সরকার নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে ব্যস্ত।
সেদিক থেকে ভাবতে গেলে আমরা ভালোই আছি অনেক। হ্যাঁ, আমাদেরও অনেক অক্ষমতা আছে। আর আমাদের মতো অসচেতন জাতির যে এর থেকে খারাপ অবস্থাতে পড়তে হয়নি, তার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করা উচিত। আর জাতি হিসেবে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে।

ঈদ চলে গেছে, অফিস শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে হয়তো আমরা করোনা নিয়েই বাঁচার টেকনিক শিখে যাব। সামনের দিনগুলোতে যেই পরিস্থিতিই হোক আমাদের ইতিবাচক থাকতে হবে, মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে আর সচেতন থাকতে হবে প্রতিদিন প্রতি সেকেন্ডে। যদি বেঁচে থাকি তবে পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি হবে, সে শিক্ষা সারা জীবন কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে বেঁচে থাকব, বিশ্বাস করতে হবে এই মহামারির খুব দ্রুত সমাপ্তি হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে।
দিন শেষে বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা লাইনই মনে পড়ে, ‘বিশ্বাস করে ঠকা ভালো, অবিশ্বাস করে অবিচার করার চেয়ে।’

লেখক: একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। [email protected]