যুবলীগ নেতা হত্যার ঘটনায় কনস্টেবলসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা

নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশ-৪ ইউনিটে কর্মরত কনস্টেবল আবু হাসান ওরফে আলালের বিরুদ্ধে বাড়িতে এসে বগুড়া শহরের যুবলীগ নেতা ফিরোজ শেখকে (৩৩) হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় শিল্প পুলিশ কনস্টেবল ও বগুড়া শহরের জহুরুল নগর ব্যাংকপাড়ার বাসিন্দা আবু হাসানকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।

ফিরোজের স্ত্রী সুমি বেগম বাদী হয়ে আজ বুধবার বগুড়া সদর থানায় পুলিশ কনস্টেবল আবু হাসানসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে এই হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অন্য আসামিরা হলেন আবু হাসানের যমজ ভাই এবং পুলিশের চাকরিচ্যুত কনস্টেবল আবু হোসেন, তাঁদের আরেক ভাই সৈকত হাসান, একই এলাকার আরিফ, এমি, হাবিবুল, বাবু ও জুম্মন। এ ছাড়া আরও ৭-৮ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে।

বগুড়া শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার দিকে শহরের জহুরুল নগর এলাকায় মাহি ভিলা নামে ছাত্রাবাসে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হামলায় গুরুতর আহত হন ইমরান হোসেন (৩২) ও মশিউর রহমান (৩৬) নামে তাঁর দুই সহযোগী।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা যুবলীগ নেতা ফিরোজের পূর্বপরিচিত। তাঁদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে ফিরোজের দ্বন্দ্ব ছিল। গতকাল বিকেলে ফিরোজ তাঁর বন্ধু ইমরান, মশিউর, সিজান ও কালামকে নিয়ে মাহি ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে বসে গল্প করছিলেন। এ সময় আসামিরা রামদা, চাপাতি, হাঁসুয়া, চাকুসহ ধারালো অস্ত্র হাতে হামলা করেন। দুই যমজ সহোদর আবু হাসান, আবু হোসেনসহ আসামিরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন।

বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রেজাউল করিম বলেন, ফিরোজ হত্যা মামলায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সিজান ও পলাশকে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে।

সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী বলেন, ফিরোজ হত্যা মামলার আট আসামির মধ্যে প্রধান আসামি আবু হাসান নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশ ইউনিট-৪ এর কনস্টেবল পদে কর্মরত। এ ছাড়া তাঁর যমজ ভাই আবু হোসেন পুলিশ কনস্টেবল থেকে চাকরিচ্যুত। তাঁদের বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

খুন দিয়ে শুরু, খুনেই শেষ
পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, চকসূত্রাপুর চাপড়পাড়ার ফজলার রহমানের ছেলে ফিরোজ এলাকায় তিলা ফিরোজ নামে পরিচিত। এলাকায় একসময় ‘টোকাই’ হিসেবে পরিচিত এই তিলা ফিরোজের ভাগ্য খুলে যায় শহর যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত ও বগুড়ার বহুল আলোচিত এক নেতার বিশ্বস্ত ক্যাডার হিসেবে আশীর্বাদ পাওয়ায়। ২০১৩ সালে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শহরের চকসূত্রাপুর-নামাজগড় এলাকায় দিনে দুপুরে নিজ বাড়িতে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় শহর যুবদলের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি ইমরান হোসেনকে।

ওই হত্যা মামলায় শহর যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ছাড়াও বগুড়ায় ছাত্রী ধর্ষণ ও মা-মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার মামলার আসামি তুফান সরকারসহ তাঁর তিন ভাইকে আসামি করা হয়। তিলা ফিরোজ ছিলেন হত্যা মামলার ৫ নম্বর আসামি। ২০১৪ সালের ২৫ আগস্ট যুবদল নেতা ইমরান হত্যা মামলার তদন্ত শেষে আলোচিত যুবলীগ নেতাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর তিন ভাই এবং তিলা ফিরোজসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই তিলা ফিরোজ বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতার বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। অল্প দিনের মাথায় রাতারাতি ফিরোজ শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে যান।

পুলিশের দাবি, ২০১৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শহরের চকসূত্রাপুর সুইপার কলোনিতে মাদক নিয়ে খুন হন চিহ্নিত সন্ত্রাসী শাকিল আহমেদ। ফিরোজ ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার প্রধান আসামি ছিলেন। এ ছাড়া পুলিশের নথিতে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট সদর থানায় দায়ের হওয়া বিস্ফোরক আইনের একটি মামলা এবং ২০০৯ সালের ১৬ জুন একটি মারধর মামলার আসামি ছিলেন ফিরোজ। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর শহরের মালগ্রামে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি সন্ত্রাসী রঞ্জু খুনেও নাম আসে ফিরোজের।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদিউজ্জামান বলেন, থানার নথিতে একটি হত্যাসহ তিন মামলা রয়েছে ফিরোজের নামে।

খুনের নেপথ্যে চার কারণ!
সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী বলেন, চার কারণ সামনে রেখে ফিরোজ হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক তদন্ত শুরু করা হয়েছে। একজন নারীকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। জহুরুল নগর এলাকার ওই নারী ছিলেন ফিরোজের দ্বিতীয় স্ত্রী। ওই নারী নিজেও মাদকের ব্যবসা করতেন। ওই নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন জহুরুল নগর এলাকার পুলিশের চাকরিচ্যুত সদস্য আবু হোসেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। খুনের আরেকটি কারণ হতে পারে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এবং মেসকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি নিয়ে আবু হাসান-আবু হোসেন গ্রুপের সঙ্গে ফিরোজের দ্বন্দ্ব।

সনাতন চক্রবর্তী আরও বলেন, আরেকটি কারণও সামনে রেখে হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। সেটা হলো যাঁর মাধ্যমে ফিরোজ জিরো থেকে হিরো বনেছিলেন, সেই রাজনৈতিক ‘বড় ভাই’। ওই বড় ভাই কয়েক দিন আগে ফিরোজকে তুলে নিয়ে মারধর করেছিলেন। খুনের নেপথ্যে ওই বড় ভাইয়ের হাত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।