ছোট্ট শিশুর দাবি বাবা, বাইরে যাও

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মার্চের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে গত দুই মাসের অধিক সময় ধরে ঘরেই আছি। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা অনলাইনে করছি বা অতি প্রয়োজনে শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতা পাচ্ছি।

সময় কাটছে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর সহকর্মীদের সঙ্গে ফোন বা অনলাইনে কথা বলে আর দেশ-বিদেশের করোনা পরিস্থিতির খবর পড়ে। কথা বলেছি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার সম্ভাবনা নিয়ে, জানার চেষ্টা করেছি তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা।

সবকিছু ঠিক থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হতে পারে অনলাইন ক্লাস। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি। ইতিমধ্যে কিছু শিক্ষা উপকরণ (পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডস, পিডিএফ বই ইত্যাদি) গুগল ক্লাসরুমের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি, যাতে অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।

অনলাইন ক্লাস পরিচালনার খুঁটিনাটি বিষয় জানতে কথা বলেছি দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের সঙ্গে, যাঁরা এ শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। অংশগ্রহণ করেছি অনলাইন শিক্ষার ওপর দুই সপ্তাহের একটি শর্ট কোর্সে, যা পরিচালনা করেছে ক্লাউডভিত্তিক ক্যাম্পাস পরিচালনাকারী অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তার পরও মনের ভেতর অজানা আতঙ্ক উঁকি দিচ্ছে, আমি কি নিরাপদ থাকতে পারব এই মহামারি থেকে? আবার কি ফিরতে পারব ছাত্রছাত্রীদের পদচারণে মুখরিত প্রিয় ক্যাম্পাসে?

অনেক আতঙ্কের মধ্যেও বেশ মজার সময় কাটছে আমাদের দুই বছরের শিশুসন্তান রেহানকে নিয়ে। করোনা না থাকলে এত সময় ঘরে থাকাও হতো না। আর ওর একটু একটু করে শেখা অনেক বিষয় উপভোগও করা হতো না। ওর দুষ্টুমি আর নানাবিধ কর্মকাণ্ড দেখে কল্পনায় ওর জায়গায় নিজেকে বসাই, আর চিন্তা করি, আমার মা-বাবা আমার কত যন্ত্রণাই না সহ্য করেছেন। মা-বাবার কথা অনেক বেশি মনে পড়ে। মাকে ফোন করি, আমার ছোটবেলা নিয়ে প্রশ্ন করি, ‘কেমন ছিলাম রেহানের মতো বয়সে? কী কী দুষ্টুমি করতাম? তোমাকে কি অনেক জ্বালাতাম?’ ইত্যাদি। মা আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেন। একটু বড় হয়ে কী করতাম সেগুলো বলেন আর হাসেন। কিন্তু মায়ের একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি থেমে যাই! মা জানতে চান, ঈদে বাড়িতে আসব কি না? মাকে আমাদের সবার নিরাপত্তার কথা বলি আর আশ্বস্ত করি, আর মাত্র কিছুদিন, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। গত রোজায়ও মা আমার সঙ্গে ছিলেন। আমরা একসঙ্গে সাহরি, ইফতার করেছি, বসে নানা বিষয়ে গল্প করেছি! এবারও এমন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের পক্ষে নয়, সে সবাইকে করে ফেলেছে ঘরবন্দী!

ছোট্ট রেহানের কথায় আসি। সে এখন দু-একটা করে শব্দ বলা শিখেছে। ঘুম থেকে উঠেই বলে ‘মিয়া’ (তার প্রিয় খেলনার নাম, নিজেই দিয়েছে)। তাকে তার প্রিয় খেলনাটি খুঁজে দিই। তার মা তার জন্য নাশতা তৈরি করতে যায়। সে আমাকে বলে, ‘বাবা, পাখি।’ তাকে বারান্দায় নিয়ে যেতে হবে, পাখি দেখাতে! ঢাকার গাছপালা এখন স্বরূপে ফিরেছে, বারান্দার সামনে রাস্তার পাশে সবুজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রজাতির পাখি দেখা যায়। পাখি দেখলেই বলে ওঠে, ‘ওই যে পাখি।’ হাত বাড়িয়ে বলে, ‘হ্যালো পাখি’, ‘আসো-আসো’। কাকগুলো খাবারের অভাবে বারান্দার গ্রিলে এসে বসে, মাঝেমধ্যে ওদের জন্য খাবার রাখি। কাকের খাবার খেতে দেখে রেহানের আনন্দ বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ। সে আনন্দে হাত-পা ছোড়ে আর পাখি পাখি বলে চিৎকার করে। বারান্দার টবে ছোট্ট একটা ফুল ফুটেছে, সেটা দেখে বলে, ‘বাবা, ফুল।’ নিচে তাকিয়ে রাস্তায় গাড়ি দেখলেই বলে ‘বাস’। দুনিয়ার সব গাড়িই তার কাছে বাস! আমাকে বা ওর মাকে গোসল করে বের হতে দেখলেই জায়নামাজ খোঁজা শুরু করে। নিজের হ্যাট (টুপিকে সে হ্যাট বলে) মাথায় দিয়ে জায়নামাজের সামনে বসে পড়ে। আমাদের মতো করেই হাত বাঁধে, সেজদা দেয়, আর বিড়বিড় করে।

মাঝেমধ্যে ওকে ছাদে নিয়ে যাই হালকা রোদ উপভোগ করার জন্য। একটু মুক্ত জায়গা পেয়ে তার আনন্দ শেষ হতে চায় না। করোনা আসার আগে ওকে নিয়ে মাঝেমধ্যে বাইরে হাঁটাহাঁটি করতাম। নিয়ে যেতাম শপিং মলে বা বাচ্চারা খেলতে পারে, এমন কোনো জায়গায়। বাসা থেকে নিচে নামার জন্য লিফট ব্যবহার করতাম, তাই লিফট তার পরিচিত। এখন ঘরের দরজা খুললেই সে লিফটের দিকে তর্জনী দিয়ে বলে, ‘বাইরে যাই।’ ওর সঙ্গে অনেক আনন্দের সময় কাটালেও, ওর বাইরে যাওয়ার এই দাবিটা পূরণ করতে পারি না। বাইরে নিতে পারি না বলে ওর ছোট্ট মনে কি অনেক কষ্ট জমা হচ্ছে না? ওকি মনে করছে না, বাবা আমার কথা রাখছে না? ওকে কী করে বোঝাব যে এখন বাইরে যাওয়ার সময় নয়, এখন সময় ঘরে থাকার। নিজের নিরাপত্তার জন্য, বাংলাদেশের সব মানুষের নিরাপত্তার জন্য। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি এই মহামারি শেষ হবে, বাইরে যাবে সব সন্তান তার মা-বাবার সঙ্গে! আবার শঙ্কাও করছি, বেঁচে থাকব তত দিন? পারব কি সন্তানের বাইরে যাওয়ার এই ছোট্ট আবদারটি পূরণ করতে?

*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]