দুর্যোগের সময় মাসিক, উপকূলের নারীর 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে ২০ মে সন্ধ্যায়। এর আগের দিন বিকেলেই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন রাজিয়া খাতুন (ছদ্মনাম)। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাঁতিনাখালী গ্রামে। উপজেলার বুড়ি গোয়ালিনী ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে এ গ্রাম। রাজিয়ার আগে থেকে ধারণা ছিল, এ সময়টায় তাঁর মাসিক শুরু হতে পারে। কিন্তু বাড়ি থেকে আসার সময় প্যাড বা কাপড় নিয়ে আসতে পারেননি। আশ্রয়কেন্দ্রে আসার পরপরই তাঁর মাসিক শুরু হয়। প্রায় দুদিনে এক সন্তানের এই মায়ের যে অভিজ্ঞতা হয়, তা ভয়ানক। রাজিয়া বলেন, 'আশপাশে কোনো দোকান ছিল না যে প্যাড কিনব। আবার সঙ্গে পুরোনো কোনো কাপড়ও নেই। তাই বারবার টয়লেটে যেতে হচ্ছিল। কিন্তু সেখানে বড় লাইন।'

রাজিয়ার সংকোচ হচ্ছিল, কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে না যায়। আশ্রয়কেন্দ্রে প্রচুর মানুষ। এ নিয়ে এক চরম বিব্রতকর অবস্থা। বাড়ি ফিরে এসে খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে প্রায় প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় একাধিকবার। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্রে যান মানুষ। কিন্তু এ সময়টায় যদি কোনো নারীর মাসিক থাকে, তবে তা তাঁর জন্য বড় বিড়ম্বনা তৈরি করে।

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নারী সংগঠন প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠনের পরিচালক শম্পা গোস্বামী বলছিলেন, 'দুর্যোগের সময় মাসিক হলে এটা নতুন একটি বিপদ হয় উপকূলীয় নারীর।'

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার পানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়। ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানার সময় এ কেন্দ্রে কয়েক শ মানুষ আশ্রয় নেয়। উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে এলাকাটি। ২০ মে দুপুরের পরে কেন্দ্রে এসেছিলেন রাজিয়া বেগম (৪৬, ছদ্মনাম)। কেন্দ্র থেকে আধা কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি। কেন্দ্রে আসার পরও তিনি বাড়িতে যান। কিছুক্ষণ পর আবার ফেরত আসেন। স্থানীয় এক নারী স্কুলশিক্ষক রাজিয়াকে ডেকে তাঁর বাড়ি যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেন। রাজিয়া জানান, তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়েটিকে বাড়িতে রেখে এসেছেন। কারণ মেয়েটি এখানে আসতে চাইছে না। না আসার কারণ, মেয়েটির পিরিয়ড শুরু হয়েছে। এখানে এসে কীভাবে পরিচ্ছন্নতার কাজ করবে, সেই চিন্তা মেয়েটির। আর মেয়েটিকে বাড়িতে রেখে রাজিয়াও স্বস্তি বোধ করছেন না। তখন ওই স্কুলশিক্ষক রাজিয়াকে পরামর্শ দেন, সন্ধ্যার আগেই মেয়েটিকে নতুন কোনো প্যাড পরিয়ে নিয়ে আসতে, যাতে অন্তত রাতটা কাটাতে পারে। তখন রাজিয়া গিয়ে পরে আবার মেয়েটিকে নিয়ে আসেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই স্কুলশিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোনো স্কুলে ছেলেমেয়ের আলাদা শৌচাগার আছে বটে। কিন্তু কাপড় বা প্যাড পাল্টানোর দরকার হলে একটা বিপত্তি দেখা দেয়। কারণ এর কোনো ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘ সময় ধরে থেকে অনেকেই এটা পাল্টাতেও পারে না। একটি কাপড়েই থাকতে হয়। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।

ঘূর্ণিঝড় বা অন্য কোনো দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে কখনো কখনো দুই দিন পর্যন্তও থাকতে হয় উপকূলবাসীকে। তবে এ সময় কখনোই তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি হওয়া উচিত না বলেই মনে করেন দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি এটাকে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বলেই মনে করেন। আর সময় সংক্ষিপ্ত হলে মাসিক চলার সময় যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নারীদের, তা কমবে। তবে এ সময়ও মাসিকের নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধির জন্য টয়লেটগুলোতে আলাদা ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। অন্তত মাসিকে ব্যবহৃত প্যাড বা কাপড় ফেলে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা রাখতে কেন্দ্রগুলোতে ব্যবস্থা থাকা উচিত।

বর্তমান বাস্তবতায় উপকূলবাসীকে দীর্ঘ সময় ধরেই কাটাতে হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। আর এ সময় শুকনো খাদ্যসহ নানা উপকরণ দেওয়া আশ্রয় নেওয়া মানুষকে। কিন্তু এ তালিকায় মাসিকের প্যাড নেই। এ সময় নারীদের মাসিক হলে তাঁর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দিকটি একেবারেই উপেক্ষিত।

একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণকাজে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা আছে ওয়াটার এইডের এ-দেশীয় প্রধান হাসিন জাহানের। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে, বিশেষ করে মাসিকের সময় উপকূলীয় নারীদের এক দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। কেন্দ্রগুলোতে নারীদের প্রাইভেসির অভাব প্রকট। কাপড় পরিবর্তন করা বা এর নিরাপদ ব্যবস্থাপনার কোনো সুযোগ নেই। এ সময়টায় কোনো নারী কাপড় ধুয়ে শুকাবেন, সেই পরিবেশও সেখানে নেই।

তাই হাসিন জাহানের পরামর্শ, ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে প্যাডের একটা ব্যবস্থা রাখা দরকার। একই সঙ্গে কেন্দ্রগুলোতে প্যাড বা কাপড় নিরাপদে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ জন্য সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে।
হাসিন জাহানের এই পরামর্শের বিষয়ে কথা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমানের সঙ্গে।প্রথম আলোকে তিনি বলেন, 'আমরা এর আগে বিষয়টি নিয়ে সত্যিই ভাবিনি। এটা অত্যন্ত ভালো পরামর্শ। আমাদের নতুন করে বিষয়টি যুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।'

প্রতিমন্ত্রী এনামুর জানান, শুধু ঘূর্ণিঝড় না, বন্যা বা অন্যান্য দুর্যোগে ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী মাসিকের প্যাড দেওয়ার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেবেন।

তবে শুধু দুর্যোগের সময় না, উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল বেশ করুণ। আর পরিচ্ছন্নতার এ সমস্যার কারণে নানা অসুখে আক্রান্ত হন তাঁরা। উপকূলের গ্রামাঞ্চলে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটি বড় অন্তরায় সুপেয় পানির অভাব। অনেককে পানির জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়। শ্রমজীবী নারীদের সমস্যা আরও প্রকট।

কল্যাণী মিস্ত্রী (২৩, ছদ্মনাম) শ্যামনগর উপজেলার জেলেখালী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ঘের ও জমিতে শ্রমিকের কাজ করেন। এই নারী দিনমজুরকে দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে কাজ করতে হয়। যেখানে কাজ করেন, সেখানে শৌচাগার নেই। বাড়ি থেকে পানি খেয়ে আসেন। তেষ্টা পেলে মেপে পানি খেতে হয়। গেল বছর প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া শুরু হয়। স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানান, প্রয়োজনমতো পানি না খাওয়ার জন্যই এ সমস্যা।

উপকূলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নিরাপদ মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুযোগ নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানে একটি শৌচাগার। সেটা ছেলেমেয়ে এমনকি শিক্ষকেরাও ব্যবহার করেন। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাকসুদার (ছদ্মনাম) কাছে শোনা যায় মাসিককালীন বিড়ম্বনার কথা। মাকসুদা পড়ে ইসলামিয়া সিদ্দিকিয়া আলিম মাদ্রাসায়। এ প্রতিষ্ঠানের একটি শৌচাগার শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই ব্যবহার করে। মাকসুদা বলে, 'শৌচাগারের অবস্থা খুব করুণ। এখানে হাত ধোয়ার বেসিন নেই। টিউবওয়েল শৌচাগার থেকে দূরে। মাসিকের সময় প্যাড বদল করে তা ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। শুকনো মৌসুমে টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। তখন পাশের একটি ঘেরের পানি ব্যবহার করতে হয়। এ সময় পরিস্থিতি সত্যিই খুব নাজুক হয়ে ওঠে।'

পানির সংকট, মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেক নারীকেই নানা অসুখে পড়তে হয়। শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগের চিকিৎসক রত্না রানী পাল এ হাসপাতালে এসেছেন পাঁচ মাস হলো। তিনি বলছিলেন, 'এখানে যেসব নারী রোগী পাই তাঁদের বড় অংশই প্রজনন অঙ্গের নানা সমস্যা নিয়ে আসেন। এর কারণ হলো মাসিকের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনার অভাব।' তাঁর পাওয়া রোগীদের বেশির ভাগই ইউরোনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) বা পিআইডিতে (পেলভিক ইনফ্লেমেটরি ডিজিজি-শ্রোণির প্রদাহ) আক্রান্ত।

রত্না পাল বলেন, 'অনেক নারী আছেন যাঁরা “প্যাড” শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত নন। এই সময়ে এটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে।'
উপকূলের গ্রামাঞ্চলে মাসিক স্বাস্থ্যবিধির সমস্যার কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, অসচেতনতা এবং পানির প্রাপ্যতার অভাবকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন খুলনার বেসরকারি সংগঠন রূপান্তরের নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার গুহ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সুলভে প্যাডের সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ এবং কাঠামোগত সংস্কারের কথাও বলেন তিনি।

দরিদ্র নারীদের জন্য সুলভে প্যাড উৎপাদনে মাঠপর্যায়ে বেসরকারি সংগঠনের এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন গবেষকেরা। এ ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে বলেও তাঁরা মনে করেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, মাঠপর্যায়ের সংগঠনগুলো কম খরচে প্যাড তৈরি করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি তহবিল গঠন করতে হবে। এই তহবিল থেকে অর্থ সংগঠনগুলোকে দিতে হবে।

মাসিক স্বাস্থ্যবিধির অভাবে নারীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এতে করে যথেষ্ট পরিমাণ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ নাজনীন। তিনি বলেন, সুলভে প্যাডের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সরকারের স্বাস্থ্য খাতের খরচও কমিয়ে দেবে।