মারা পড়ল মা গোকুল, চার ছানা বাঁচবে তো?

উদ্ধার করা ছানা। ছবি: ফেসবুক
উদ্ধার করা ছানা। ছবি: ফেসবুক

বাড়ির ছাদে নির্জন জায়গা পেয়ে বাসা বেঁধেছিল গন্ধগোকুলটি। ছানাও তুলেছে চারটি। সবে চোখ ফুটেছে ছানাদের। মা গেছে খাবারের খোঁজে। এই ফাঁকে কিছু দুষ্ট ছেলে সেই ছানাদের নিচে নামিয়েছে। এটি দেখে মা এসেছিল ছানাদের রক্ষা করতে। শেষ রক্ষা হলো না। মাকে প্রাণ দিতে হলো। তবে ছানাদের উদ্ধার করা গেছে।

এ ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায়। সেখান থেকে গন্ধ গোকুলের (Indian Civet) চারটি বাচ্চা উদ্ধার করেছেন একজন বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী। তিনি জানান, উদ্ধারের আগে মা গন্ধগোকুলটিকে মেরে ফেলা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে শাজাহানপুর উপজেলার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় এই চারটি বাচ্চা।

বগুড়া বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং বন্য প্রানী আলোকচিত্রী তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বলেন, আজ বেলা দুইটায় ওই এলাকার একজন ফোন করে বলেন, কিছু শিশু গন্ধগোকুল এবং এর চারটি বাচ্চাকে কাছের একটি বাড়ির ছাদ থেকে ধরে এনেছে। পরে এ খবরে আমি প্রাণীগুলোকে উদ্ধার করার জন্য বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুইয়া এবং বাংলাদেশের বন্য প্রানী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহির উদ্দিন আকন্দকে ট্যাগ করে ফেসবুকে পোস্ট দিই। পুলিশ সুপার ওই থানার ওসির সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেন।

তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বলেন, ‘বিকেল চারটার সময় পুলিশের সহযোগিতায় একটি বাড়ি থেকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্যের উপস্থিতিতে বাচ্চাগুলো উদ্ধার করি। ছানাগুলোকে এখন বগুড়ার পরিবেশবাদী একটি সংঘটন “তীর”–এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’ সুস্থ হলে এবং পরিবেশে ছাড়ার উপযোগী হলে কাছের জঙ্গলে এগুলোকে উন্মুক্ত করা হবে বলে তিনি জানান।

বন বিভাগের কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা গন্ধগোকুলের ছানা দেওয়ার মৌসুম। ওই এলাকার দুষ্টু ছেলেরা আমরা যাওয়ার আগেই মাকে মেরে ফেলেছে। বাচ্চাগুলো খুব ছোট। বাচ্চা চারটি ইঁদুরের চেয়ে একটু বড়। এখন বাচ্চাগুলো আমরা তদারক করছি। একটি সংগঠন এদের বাঁচাতে কাজ করছে। তারা আমাদের সাথে কাজ করে। প্রাণী বিশেষজ্ঞ ইকবালসহ আরও কয়েকজন এগুলোর দেখাশোনা করছেন। ফিডার কিনতে হবে। দুধ দিতে হবে। ঠিকমতো যত্ন নিলে বাচ্চারা বেঁচে যেতে পারে।’

ছানাগুলোর এখন যত্ন চলছে। ছবি: ফেসবুক
ছানাগুলোর এখন যত্ন চলছে। ছবি: ফেসবুক

বন্য প্রণী বিশেষজ্ঞ শরিফ খান বললেন, গন্ধগোকুল শত্রু দেখলে একধরনের কাঁদানে গ্যাস স্প্রে করে, সেটি আত্মরক্ষার হাতিয়ার। পাশাপাশি আরও একটি গ্রন্থি এদের রয়েছে, সেটি থেকে বেরোয় একধরনের আঠালো সুগন্ধি রস, নাম যার Civet scent। এরা দেখতে পোষা বিড়ালের মতো অনেকটাই, চোখা মুখ, লম্বা লেজ ও একনজরে বাদামি রঙের এই প্রাণীটির লেজে আছে সাতটি চওড়া কালো বলয়, গলার নিচে দুটো কালো-চওড়া টান, পিঠের ওপর থেকে মেরুদণ্ড বরাবর মোট ছয়টি লম্বা বাদামি রেখা বয়ে গেছে লেজের গোড়া বরাবর, সারা শরীরেই বুটি বুটি আঁকা। লম্বাটে শরীর, খাটো পা। নিরীহ স্বভাবের এই প্রাণীটিকে নানা এলাকায় ডাকা হয় নানা নামে: গন্ধগোকুল, ছোট বাগডাশ, ছোট খাটাশ, গন্ধগুলা, হাইলটালা ইত্যাদি। ফকিরহাট-বাগেরহাটে এটি ‘ঘোইলো’ নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম Small indian civet। বৈজ্ঞানিক নাম Viverricula indica। শরীরের মাপ লেজসহ ৯০ সেন্টিমিটার। ঘাড় থেকে উচ্চতা ২২ সেন্টিমিটার। ওজন দু-তিন কেজি। বাঁচে ১৫ বছর।

শরিফ খান বলেন, গন্ধগোকুল গেরস্তবাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, বাগান, পরিত্যক্ত ঘরবাড়ির মাচান ইত্যাদি জায়গায় থাকে। কিন্তু মানুষ এদের আপন তো করেইনি, বরং শত্রুজ্ঞানে মেরে ফেলে। এটা যেন ঐতিহ্যবাহী খেলা আমাদের দেশে। এদের খাদ্যতালিকা বিশাল। ধেনো ইঁদুর, গেছো ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, পাখি ও পাখির ডিম, ব্যাঙ-শামুক, সুযোগ পেলে গেরস্তদের হাঁস-মুরগি-ছাগলছানা ইত্যাদি। সব ধরনের ফল খায়। তাল-খেজুরের রস এদের প্রিয় পানীয়। কামড়ের শক্তি অবিশ্বাস্য। বিপদে পড়লে কুকুরের নাক-মুখ কামড়ে ধরলে কুকুর মুক্ত হতে পারে না সহজে। বছরে কমপক্ষে দুবার ছানা তোলে এরা। প্রতি প্রসবে তিন-চারটি। মোটা গাছের গোড়ার ফোকরে-কোটরে, পাহাড়-টিলার ফাটল-ফোকরে অথবা মাটিতে গর্ত করে আঁতুড়ঘর বানায়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে সারা দেশেই এদের দেখা মিলত। এখন নজরে পড়ে ক্বচিৎ।