স্বাস্থ্য খাতে উপেক্ষিত অণুজীববিজ্ঞানীরা

দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অণুজীববিজ্ঞানীদের যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না, এমন অভিযোগ অনেক দিন ধরেই করে আসছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বেতন স্কেলের নবম গ্রেডে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্টসকে বিবৃতি দিয়ে দাবি জানাতে হয়। কোভিড-১৯- এর প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে তারা এই দাবি করেছে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চিকিৎসকের পাশাপাশি অন্য পেশাজীবীদেরও ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে। যেমন দেশে যে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে, তা করেছেন অণুজীববিজ্ঞানীরা। আবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বিজন শীলের নেতৃত্বে করোনাভাইরাস পরীক্ষার যে কিট বানানো হয়েছে, সেই বিজন শীলও একজন অণুজীববিজ্ঞানী। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এই অণুজীববিজ্ঞানীদের ভূমিকা খুব কম। সরকারের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় বিভিন্ন গ্রেডে তাঁরা কাজ করছেন, কিন্তু সেই সংখ্যাও খুব কম। পৃথক ক্যাডার বা পদ না থাকায় তাঁরা স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। অণুজীববিজ্ঞানীরা মনে করেন, সরকার যে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় অণুজীববিজ্ঞানীদেরও নিয়োগ দেওয়া উচিত। তাঁরা এ–ও মনে করেন, অণুজীববিজ্ঞানীদের সঙ্গে জৈব রসায়নবিদ, জৈবপ্রযুক্তিবিদ ও গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরও নিয়োগ দেওয়া উচিত।
ভাইরাস নিয়ে অণুজীববিজ্ঞানীরাই বিশদভাবে কাজ করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে অংশগ্রহণ না থাকায় করোনাভাইরাসজনিত মহামারির সময় তাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্টস স্বাস্থ্য খাতে নবম গ্রেডের পদ তৈরির দাবি জানিয়েছে।
১৯৯২ সালে প্রথম সরকারি হাসপাতালগুলোয় অণুজীববিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু পরের বছরই এ নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। সৃষ্ট পদগুলোতে কাজ করছেন চিকিৎসকেরা। অণুজীববিজ্ঞানীরা মনে করেন, এতে সেই চিকিৎসকেরা মূল কাজে বেশি সময় দিতে পারছেন না।
অন্যদিকে দেশের সব মেডিকেল কলেজ, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জৈবপ্রযুক্তি বিভাগ থাকলেও চাকরি পান না জৈবপ্রযুক্তির শিক্ষার্থীরা। অথচ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি এখন পড়ানো হয়। স্নাতকদের একাংশ বিদেশে যায়, অন্য অংশ দেশে অন্য ক্ষেত্রে কাজ করে, আর ১ শতাংশ হয়তো নিজের ক্ষেত্রে কাজ পায় বলে অভিযোগ করেছেন জৈবপ্রযুক্তির স্নাতকেরা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন তাঁরা।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্টের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা সরকারি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় নানা গ্রেডে কাজ করছেন, কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে তাঁদের ভূমিকা রাখার সুযোগ কম। সে জন্য আমরা অণুজীববিজ্ঞানীদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে নবম গ্রেডে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদ সৃষ্টির দাবি তুলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, গবেষণার মাধ্যমে অণুজীববিজ্ঞানীরা সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় বড় ভূমিকা পালন করতে পারবেন।’
আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে পিসিআর টেস্ট, প্রশিক্ষণ ও ল্যাব সেটআপের ক্ষেত্রে অণুজীববিজ্ঞানের স্নাতকদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। ভালো উদ্যোগ। এই প্রক্রিয়াকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য আমরা চাই, অর্গানোগ্রাম তৈরি করে স্বাস্থ্য খাতে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হোক। পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিক পাঠদানের জন্য শিক্ষা ক্যাডারেও অণুজীববিজ্ঞানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এতে শিক্ষার্থীরাই উপকৃত হবে।’
স্প্যানিশ ফ্লু হোক, কিংবা একবিংশ শতাব্দীর করোনার আক্রমণই হোক—সবই মূলত অণুজীবের তাণ্ডবলীলা। মোটাদাগে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাক ও শৈবাল নিয়ে যে বিজ্ঞান বা শাস্ত্র, তা–ই অণুজীব বিজ্ঞান। তাই অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্ররাই ভাইরাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। অনেকে মাস্টার্স থিসিসেও সুনির্দিষ্ট ভাইরাসের ওপর গবেষণা করে থাকেন। ফলে ভাইরাসের জিনোমিক ম্যাটেরিয়াল (ডিএনএ/আরএনএ), ট্রান্সক্রিপশন, ট্রান্সলেশন ও সর্বোপরি বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার সম্পর্কে অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্ররা বিশেষ জ্ঞান রাখেন। বর্তমানে করোনাভাইরাস টেস্টের জন্য যে আরটি-পিসিআর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়, তার জন্য দক্ষ জনশক্তির অভাব দেখা যাচ্ছে। অথচ অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্ররা এ কাজটি অত্যন্ত সুচারুভাবে করতে সক্ষম।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে অণুজীববিজ্ঞানীদের মতো পেশাজীবীরা সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারেন। এতে স্বাস্থ্য খাত সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্টস যে দাবি তুলেছে, তার বাস্তবতা আছে। ভবিষ্যতে আমরা বিষয়টি ভেবে দেখব।’
অণুজীববিজ্ঞানের স্নাতকেরা বলছেন, ক্লিনিক্যাল ডায়াগনস্টিক টেস্ট নির্ভুলভাবে করতে তাঁদের আরও কাজে লাগানো উচিত। এসব করতে চিকিৎসকদের সময় ব্যয় করতে হয়, যে সময় তাঁরা চিকিৎসায় দিতে পারেন।