নিউজিল্যান্ডের মতো সুদিনের অপেক্ষায়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

সাধারণ ছুটি ও ঘরবন্দী সময় দুই মাস পেরিয়ে গেল। এরই মধ্যে দীর্ঘ এক মাস রমজানের শেষে যে খুশির ঈদও এসেছিল অচেনা রূপে। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ১৮ মার্চ থেকে। ১৯ মার্চ বাড়িতে ফিরেছি। সে থেকে বাড়িতে কার্যত বন্দী।

বাড়িতে দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে সঙ্গজনেও। আগে যেখানে একাডেমিক পড়াশোনা বা নিউজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, এখন সময় কাটছে ছাদবাগান করে। সারাক্ষণের সঙ্গী হয়েছে প্রিয় দুই ভাতিজি আমরিন ও রিদাহ। ঘরবন্দী এ সময়টা তাদের কাছেও অপরিচিত। বিকেলে ছাদে তাদের খেলার সঙ্গী হয়ে তাদের সময়টাকে আনন্দঘন রাখার চেষ্টা করি।

আমরিন ও রিদাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে গিয়ে দেখেছি শিশুদের মন কত সুন্দর, ভাবনা কত পরিশীলিত। গোসল করার সময় তাদের মাথায় শ্যাম্পু দিলে তারাও আমার মাথায় শ্যাম্পু দেবে। আমি যেমন তাদের আদর-যত্ন করছি, তারাও আবার তাদের প্রিয় পুতুলের যত্ন নিচ্ছে। খাওয়াচ্ছে, গোসল করাচ্ছে। তাদের যেসব কথা বলে ভাত খাওয়াতে রাজি করাচ্ছি, তারাও ঠিক সেসব গল্প বলে খরগোশকে খাবার দিচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এড়িয়ে চলছি অনেক দিন ধরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গেলেই শুধু মৃত্যুর খবর, আক্রান্তের খবর, অমানবিকতার খবর, হতাশার খবর। তবে মন ভালো করার খবরও আছে। আমাদের ডাক্তার, পুলিশসহ তরুণেরা নিজ নিজ জায়গায় লড়ছেন করোনার বিরুদ্ধে। বাড়িতে ঘরবন্দী এ সময়টা মোবাইল স্ক্রিনের ছোঁয়ার চেয়ে মা–বাবা ও পরিবার–পরিজনে সঙ্গকে গুরুত্ব দিচ্ছি। যতটুকু সম্ভব আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর খোঁজ রাখছি।

আমার চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় আশঙ্কাজনক সংখ্যায় রোগী শনাক্ত হওয়ায় মহল্লাবাসী সবচেয়ে জোর দিচ্ছি সামাজিক সচেতনতা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে। এ ছাড়া ঈদের জামাতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ও হাত মেলানো বা কোলাকুলি এড়ানো হয়েছে ভালোভাবে। এসব কাজে সামাজিক সংগঠন ‘পশ্চিম আমিরাবাদ যুব ঐক্য পরিষদ–এর কর্মীরা সহযোগিতা করছেন এলাকাবাসীকে। আল্লাহর অশেষ রহমতে দীর্ঘ দুই মাস এলাকাবাসীর সচেতনভাবে চলাচল উপজেলায় সংক্রমণ থাকলেও এলাকায় কোনো দুঃসংবাদ নেই।

ঘরবন্দী সময় শেষ হতে চলেছে। ৩১ মে থেকে ‘সীমিত পরিসরে’ গণপরিবহনসহ সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে সরকার। কিন্তু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুতে আমাদের কাছে এখনো কোন স্বস্তির খবর নেই।

২৭ মে সরকারি হিসাবে ২২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ৫৪১ জন নতুন আক্রান্তসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮ হাজার ২৯২। সুস্থতার সুসংবাদ নিয়ে আজ পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে পেরেছেন ৭ হাজার ৯২৫ জন। যেহেতু সবকিছু ‘সীমিত পরিসরে’খুলে দেওয়া হচ্ছে, তবে ধীরে ধীরে মানুষ কর্মস্থলে ফেরা শুরু করবে। সেখানেও অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব ও অস্পর্শিয়া সময় পার করতে হবে।

নিউজিল্যান্ডে আজ (পড়ুন গতকাল) সর্বশেষ করোনা রোগী হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। আমরা সে রকম একটি সুদিনের জন্য অপেক্ষা করছি। যেদিন একজনও রোগী থাকবে না। অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে মানুষকে ঘরে বন্দী থাকতে হবে না। অস্পর্শে দূরে থাকতে হবে না। সচল হবে সবকিছু চায়ের দোকান, গাড়ির চাকা, টিএসসি, ফার্মগেট।

তবে চলমান এই মহামারি আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে। আমরা যেন সেসব মনে রাখি, বিপদের মুখে তারুণ্যের জয়জয়কার যেমন আছে, তেমনি চাল চোর জনপ্রতিনিধিদেরও দেখেছে দেশ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ধনী-দরিদ্র সবাই। এই মহামারি আমাদের স্পষ্ট শিখিয়ে দিয়ে গেছে এই পৃথিবীতে একা বাঁচা যায় না। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হয়। মন্দির পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। তাই আমরা যেন মন্দির, দেবালয় সব নিরাপদ করার কথা ভাবি। একটি সমৃদ্ধ ও সমতার দেশ তৈরিতে মনোনিবেশ করি। সম্পদের অসমতা, প্রকৃতির প্রতি অন্যায্য আচরণ থেকে যেন পৃথিবী সরে আসে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ভার্চ্যুয়ালিটিতে নিমগ্ন না থেকে মা–বাবা ও পরিবারের জন্য যেন দিনের একটা সময় রাখার অভ্যাস তৈরি করি। সর্বোপরি আমরা যেন একটি প্রকৃতিবান্ধব ও মানবিক পৃথিবীর শপথ নিই।

লেখক: শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]