আমার ছেলে ফিরে এসেছে, এর চেয়ে আনন্দ কী আছে?

চিকিৎসক ও নার্সদের সেবায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আজ শনিবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে যান শহীদুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো
চিকিৎসক ও নার্সদের সেবায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আজ শনিবার শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে যান শহীদুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিকন্দি ইউনিয়নের বগাদি গ্রামের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম (৩৫) ঢাকার সিদ্দিক বাজারের একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে তিনি গত ২৫ এপ্রিল গ্রামের বাড়ি আসেন। সেদিনই তিনি জ্বর, ঠান্ডা ও কাশিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতে বৃদ্ধ মা একা থাকায় ছেলেকে চিকিৎসকের কাছে নিতে পারেননি। তাঁদের সহায়তা করার জন্য বিভিন্নজনের কাছে ছুটে গেছেন। কিন্তু করোনা সন্দেহে এগিয়ে আসেননি প্রতিবেশী, স্বজন ও গ্রামবাসী কেউ। শহীদুলের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ২৮ এপ্রিল রাতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।

এরপর এলাকার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে শহীদুল মারা গেছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ গ্রামবাসীর মাধ্যমে মৃত্যুর খবর পেয়ে মরদেহ উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। খবর পান ওই ইউনিয়নে কর্মরত স্বাস্থ্য সহকারী সাদ্দাম হোসেনও। তিনি ছুটে যান শহীদুলদের বাড়িতে। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখেন, শহীদুল বেঁচে আছেন। তাঁকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এ নিয়ে ৫ মে ‘করোনাকালে বৃদ্ধা মা ও তাঁর ছেলের জীবন থেকে নেওয়া গল্প’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের টানা ২৪ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন শহীদুল। ২৩ মে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে যান।

শহীদুলের খোঁজ নিতে গতকাল শুক্রবার আবুরা গ্রামে যান এ প্রতিবেদক। কথা হয় তাঁর মা সালেহা বেগমের সঙ্গে। শহীদুল কেমন আছেন জানতে চাইলে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে থাকেন মা। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, গ্রামের কোনো মানুষ তাঁদের পাশে দাঁড়াননি। ছেলে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। সবাই বলেছে ছেলে করোনায় মারা গেছে। তিনি অসহায় হয়ে ছেলের শয্যাপাশে বসে শুধু কেঁদেছেন আর আল্লাহকে ডেকেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা উদ্ধার না করলে ছেলেটা সত্যিই মারা যেত। তিনি বলেন, ‘আমার মৃত ছেলে ফিরে এসেছে, এর চেয়ে আনন্দের কী আছে? চিকিৎসকেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছেলেকে সুস্থ করেছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’

যোগাযোগ করলে স্বাস্থ্য সহকারী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ওই যুবককে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে সহায়তা করার জন্য অনেককে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কোনো গ্রামবাসী এগিয়ে আসেনি। আমরাই খাটিয়ায় করে আধা কিলোমিটার রাস্তা কাঁধে চাপিয়ে তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলি। আল্লাহর রহমতে তিনি সুস্থ হয়েছেন। একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আমার খুব ভালো লাগছে।’

আজ শনিবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এবং আইসোলেশন ওয়ার্ডে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাতে সদর হাসপাতালে যান শহীদুল। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুই দিন আগের ও দুই দিন পরের ঘটনা মনে করতে পারছি না। যখন চেতনা ফিরে পাই, তখন নিজেকে হাসপাতালের শয্যায় আবিষ্কার করি। মায়ের মুখে শুনেছি, আমি মারা গেছি এমনটা প্রচার করেছে গ্রামবাসী।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবার প্রচেষ্টায় আমি সুস্থ হয়ে নতুন জীবন পেয়েছি। করোনা কোনো আতঙ্ক নয়। চিকিৎসকের পরামর্শে চললে আর সঠিক চিকিৎসাসেবা পেলে সুস্থ হওয়া যায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি বেঁচে মায়ের কাছ ফিরতে পেরেছি।’

শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনির আহমেদ খান বলেন, ওই যুবককে হাসপাতালে ভর্তি করার দুই দিন পর চেতনা ফিরে আসে। আরও দুই দিন পর্যন্ত তিনি কিছু মনে করতে পারছিলেন না। চিকিৎসাসেবায় তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছেও ভালো লাগছে চিকিৎসক, নার্সদের প্রচেষ্টায় করোনায় আক্রান্ত একজন মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে ফিরেছেন।’