কামরুলের মাথায় ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন ঢুকিয়েছিল দালালেরা

লিবিয়ায় নিহত কামরুল শেখ।
লিবিয়ায় নিহত কামরুল শেখ।

সংসারে নিত্য অভাব। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। পড়াশোনা বেশি করা হয়নি বলে চাকরির চেষ্টা করেননি কামরুল। এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোয়ালা গ্রামের আবদুর রব মোড়লের। এই দালাল আবদুর রবই কামরুলের মাথায় ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন ঢুকিয়ে দেন। অল্প কিছু টাকা হলেই ইতালি গিয়ে উন্নত জীবন সম্ভব বলে জানান তিনি। কিন্তু অবৈধ পথে ইতালি যেতে গিয়ে প্রাণটাই গেল কামরুলের।

কামরুল শেখের (২৫) বাড়ি ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামে। গৃহযুদ্ধকবলিত দেশ লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে গত বৃহস্পতিবার দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন কামরুল। ওই ঘটনায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসী নিহত হয়েছেন। আহত হন ১১ জন। আহত ব্যক্তিদের একজনের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধা ইউনিয়নের দোলকুন্ডু গ্রামে। তাঁর নাম সাজিদ (২২)।

ফরিদপুরের দুই উপজেলার দুই তরুণ মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রায় অভিন্ন পথের পথিক হন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! অপহরণকারী দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে একজন নিহত হন এবং আহত হন অপরজন। কামরুলের বাড়িতে এখন মাতম। সাজিদ পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে লিবিয়ার ত্রিপলিতে একটি হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

কামরুল সালথার বল্লভদী ইউনিয়নের কবির শেখ ও জামেলা বেগম দম্পতির ছেলে। তাঁরা পাঁচ ভাইবোন। ভাইদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পড়াশোনা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর জমিতে কাজ করতেন। পাঁচ বছর আগে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার আলিমুদ্দিনের মেয়ে মিনাকে (২০) বিয়ে করেন। তাঁদের দুই বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। নাম রমজান।

কবির শেখ জানান, মুকসুদপুর উপজেলার গোয়ালা গ্রামের আবদুর রব মোড়ল নামের দালাল কামরুলের মাথায় স্বপ্ন ঢুকিয়ে দেন ইতালি যাওয়ার। কিছু জমি বিক্রি করে এবং সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা জোগাড় করে দালাল আবদুর রবের হাতে দেওয়া হয়। গত ডিসেম্বরে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন কামরুল।

কামরুলের বড় ভাই ফারুক শেখ জানান, দালাল চক্র কামরুলসহ আরও কয়েকজনকে প্রথমে ভারতে নিয়ে যায়। করোনার কারণে ভারতে অনেক দিন আটকা পড়েন তাঁরা। ১৬ দিন আগে কামরুল ফোন করে জানান, তাঁরা লিবিয়ায় পৌঁছেছেন। আর পাঁচ দিন আগে একটি অডিও বার্তা (ভয়েস মেসেজ) পাঠান কামরুল। তাতে জানান, তাঁদের জিম্মি করা হয়েছে। ১০ লাখ টাকা দিতে হবে মুক্তিপণ হিসেবে। ফারুক বলেন, ‘মুক্তিপণের এত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তা ছাড়া টাকা কোথায়, কীভাবে দিতে হবে, তা-ও আমাদের জানায়নি।’ তিনি বলেন, গত শুক্রবার জানতে পারেন মুক্তিপণ না দেওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ২৬ তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

প্রতিবেশীরা বলছেন, ছেলেকে নিয়ে বাবা ও মা স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিবারের অবস্থার পরিবর্তনের, স্বামীকে নিয়ে স্ত্রী স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন একটি জীবনের, দুই বছরের শিশুটি বাবা বলতে অজ্ঞান ছিল। আজ সেই কামরুল সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে তাঁদের সবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

কামরুলের স্ত্রীর মুখে ভাষা নেই, ছেলে রমজান ভাবলেশহীন। হৃদয়বিদারক আহাজারি দিয়ে মা জামেলা বলছেন, ‘ওরে, আমার কী সর্বনাশ হয়ে গেল!’ আহাজারির মধ্যেই তিনি ছেলের মৃতদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।

লিবিয়ায় নিহত কামরুল শেখের পরিবারের সদস্যদের আহাজারি। আজ শনিবার ফরিদপুরের সালথায়। ছবি: প্রথম আলো
লিবিয়ায় নিহত কামরুল শেখের পরিবারের সদস্যদের আহাজারি। আজ শনিবার ফরিদপুরের সালথায়। ছবি: প্রথম আলো

লিবিয়াতে অপহরণকারীদের গুলিতে আহত সাজিদ ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধা ইউনিয়নের দোলকুন্ডু গ্রামের বেলায়েত চোকদার ও সাগরী বেগম দম্পতির ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সাজিদ সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বিদেশে যাওয়ার শখ। দালালদের মাধ্যমে অবৈধ পথে স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে সাজিদ আজ লিবিয়ার একটি হাসপাতালে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন।
সাগরী বেগম জানান, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মাত্র এক মিনিটের জন্য কথা হয় সাজিদের সঙ্গে। সাজিদ জানান, ‘মা, আমি ভালো নেই। আমার জন্য দোয়া করো। আমি এখন হাসপাতালে।’

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, লিবিয়ায় অপহরণকারীদের গুলিতে ফরিদপুরের সালথার তরুণ কামরুল নিহত ও ভাঙ্গার তরুণ সাজিদ আহত হয়েছেন। দুটি বাড়িতেই গিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে তাঁরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে সরকারিভাবে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য তাঁরা পাননি।