করোনাকালে কুকুর-বিড়ালের খাবারের বন্দোবস্ত করেন তাঁরা

ক্যাম্পাসের কুকুরদের রান্না করা খাবার দিচ্ছেন এক শিক্ষার্থী। গত সোমবার (২৫ মে) শেষ বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ছবি: প্রথম আলো
ক্যাম্পাসের কুকুরদের রান্না করা খাবার দিচ্ছেন এক শিক্ষার্থী। গত সোমবার (২৫ মে) শেষ বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ছবি: প্রথম আলো

প্রথমে শুধু চাল ও ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াতেন, পরে এর সঙ্গে মুরগির মাথা ও পা দিয়ে রান্না শুরু হলো। খড়ি সংগ্রহ করে চলছিল রান্নার কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক গ্যাসের চুলার ব্যবস্থা করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ অন্য শিক্ষকেরাও চাল-ডাল কিনে দিতে শুরু করেন। সাবেক, বর্তমান শিক্ষার্থীরাও এই কাজকে উৎসাহ দিতে সাহায্য পাঠাচ্ছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থীর নেওয়া উদ্যোগের নাম এখন ‘ক্যাম্পাস পোষা প্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্প’।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে করোনার দুঃসময়ে ক্যাম্পাসের অভুক্ত কুকুর-বিড়ালদের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। গত ২৯ মার্চ এই উদ্যোগের শুরু হয়েছিল। এখন চলছে ৫৬তম দিন। এর মধ্যে এক দিন ছিল ঈদ। সেদিনও ওদের খাওয়ানো বাদ যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কুকুর-বিড়াল-প্রকৃতির সঙ্গেই তাঁরা ঈদ উদ্‌যাপন করেন।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ১৮ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। সেদিনই ক্যাম্পাসের সব খাবারের দোকানও বন্ধ হয়ে যায়। এর কয়েক দিন পর আশপাশের খাবার দোকানও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ক্যাম্পাসে থাকা কয়েক শ কুকুরকে না খেয়ে থাকতে হয়। এই অপ্রত্যাশিত ছুটিতেও ক্যাম্পাসের কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়ে গেলেন। কয়েক দিনের মধ্যে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলেন, কুকুরগুলো ক্ষুধায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। অভুক্ত কুকুরদের জন্য খাবার নিয়ে এগিয়ে এলেন দুজন শিক্ষার্থী। ওই দুই শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের প্রসেনজিৎ কুমার এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী মাহমুদ সাকী। তাঁদের এই কর্মকাণ্ডকে ভালোবেসে একে একে আরও যোগ দিলেন ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের তুষার সরকার, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের ইসতিয়াক মাহমুদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রাকিবুল হাসান এবং ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের তামির হোসেন। তামিরের বাড়ি আফ্রিকার দেশ সোমালিল্যান্ডে।

শিক্ষার্থীরা জানান, তাঁরা গত ২৯ মার্চ থেকে ক্যাম্পাসে কুকুরগুলোকে প্রথমে খাবার দেওয়া শুরু করেছিলেন, সে সময় তাঁরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খাবার দিতেন। পরে এক সপ্তাহ পর থেকে তাঁরা সন্ধ্যার পর খাবার দেওয়া শুরু করেন। প্রথমে এক শর মতো কুকুর থাকলেও খাবার পেয়ে আশপাশের কুকুরও ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করে। এই কুকুরগুলোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ক্যাম্পাসের বিড়ালগুলোকেও খাবার দিয়ে যাচ্ছেন।

গত সোমবার (২৫ মে) ঈদের দিন বিকেলে ক্যাম্পাসের রাকসু ভবনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো রান্না চলছে। ১০ কেজি চালের সঙ্গে ৫ থেকে ৬ কেজি মুরগির পা ও মাথা। পাশেই স্থানীয় ইসতিয়াক মাহমুদের বাড়ি থেকে আনা ঈদের খাবার খাচ্ছিলেন অন্যরা। কেউ কেউ গান ধরছিলেন। কোন কুকুর–বিড়ালের বর্তমান অবস্থা কী, তার বর্ণনা করছিলেন কেউ কেউ। রান্না শেষ হতেই খাবারগুলো ভাগ করে প্যাকেট করা হয়। এরপর সাইকেল চড়ে তাঁরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে কুকুরগুলোকে খাবার দেন। প্রতিদিন খাবার দিতে দিকে প্রাণীগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে এই শিক্ষার্থীদের। খাবার বিতরণ আর কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে তাঁদের সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়।

রান্না শেষে কুকুরদের জন্য খাবার নিয়ে ক্যাম্পাসে বেরিয়ে পড়ছেন একদল শিক্ষার্থী। গত সোমবার (২৫ মে) শেষ বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ছবি: প্রথম আলো
রান্না শেষে কুকুরদের জন্য খাবার নিয়ে ক্যাম্পাসে বেরিয়ে পড়ছেন একদল শিক্ষার্থী। গত সোমবার (২৫ মে) শেষ বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষার্থী মাহমুদ সাকী বললেন, এদের সঙ্গেই এবার তাঁদের ঈদ। এই পোষা প্রাণীগুলোকে রেখে তাঁরা বাড়িতে গিয়ে ঈদ করতে পারতেন না। ঈদের দিন ক্যাম্পাসের কাছাকাছি থাকা অনেকেই খাবার পাঠিয়েছেন তাঁদের (শিক্ষার্থী) জন্য। এতেই তাঁদের ঈদ হয়েছে। প্রসেনজিৎ কুমার বললেন, এই পোষা প্রাণীদের খাওয়াতে গিয়ে তাঁরা অনেক কিছু শিখছেন। এই প্রাণীরা মানুষের পরম বন্ধু। এদেরকে ভালোবাসলে এরাও ভালোবাসে। তাই সবাইকে এদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। এটা তাঁরা আরও বৃহত্তর পরিসরে চালিয়ে যাবেন; এমনকি দেশ স্বাভাবিক হলেও।

ইসতিয়াক ও তুষার বললেন, এবার করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হলেও কুকুর-বিড়ালকে খাবার দিয়ে তাঁরা যে আনন্দ পাচ্ছেন, সে অর্থে এটাই তাঁদের সেরা ঈদ। তাঁদের এই আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন সোমালিল্যান্ডের তামির হোসেন। প্রকল্পটি শুরুর কয়েক দিনের মাথায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, এটা খুবই ভালো লাগে তাঁর। একটা মহৎ কাজ। এই কাজে অংশ নিতে পেরে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করছেন। আনন্দ পাচ্ছেন।