স্বপ্ন এক সুন্দর পৃথিবীর

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

সময়টা মার্চ মাস। চীনের উহান থেকে কোভিড–১৯ রোগ তখন অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে। ক্যাম্পাসে চলছিল চরম গুঞ্জন। বাংলাদেশে কোভিড–১৯–এর প্রভাব কী হতে পারে, তা–ই ছিল প্রধান আলোচনা সবার মধ্যে। কিন্তু যেদিন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে তিনজন করোনা রোগী শনাক্ত হলো, সেদিন সত্যিই কপালে ঘাম জমে উঠল। চোখে দেখা দিল ভয়, মনে শঙ্কা।

বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। বিশ্ববিদ্যালয় কেন বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে না, এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটু ক্ষোভ বিরাজ করছিল। এসবের তোয়াক্কা না করেই কেউ কেউ বাড়ির পথ ধরলেন।

সেদিন ছিল ১৭ মার্চ, জাতির জনকের জন্মদিন। পূর্বে বুক করে রাখা টিকিট নিয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। স্টেশনে সেই চিরায়ত রূপ, মানুষের ব্যস্ততা, কুলিদের চঞ্চলতা, হকারদের হাঁকডাক, স বমিলিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত এক জায়গা। ট্রেনের জানালায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম দূরে। ভাবছিলাম, পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে যেখানে অজস্র মানুষ এক দিন কাজ না করলে অনাহারে থাকতে হয়, সেখানে লকডাউন দিলে ওদের অবস্থা কী হবে!

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল লিভ দিয়ে দিয়েছিল । ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল ক্যাম্পাস। হোটেলমালিকদের চোখে–মুখে দেখেছিলাম অজানা দীর্ঘশ্বাস। আসলে তখনো কারও কোনো ধারণা ছিল না, কী ঘটতে চলেছে বাংলাদেশে!

আজ ৩০ মে । ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে এসেছি দুই মাস পার হয়ে গেছে। আজ চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, কী ঘটছে বাংলাদেশে। দিন দিন বেড়েই চলেছে করোনা রোগীর সংখ্যা। অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে ভবিষ্যৎ। কষ্ট লাগে যখন দেখি প্রশাসন সবকিছু লকডাউন করে দেওয়ার পরও আমরা সেটা না মেনে ঘুরতে বের হয়ে পড়ি, অকারণেই বাজারে যাই, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাই, মোড়ে মোড়ে আড্ডা দিই। করোনাভাইরাসটা হলো এমন যে যিনি আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি সেটা টের পাওয়ার আগেই আরও কয়েকজনকে আক্রান্ত করে ফেলে। আমি নিশ্চিত, এখনো বাংলাদেশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা করোনা সম্পর্কে অজ্ঞ। তা ছাড়া করোনার উপসর্গ থাকলে লোকলজ্জার ভয়ে সেটা গোপন করার এক মানসিকতা আমাদের রয়েছে। আমাদের সবার এ ধরনের মানসিকতা পরিহার করতে হবে।

আরেকটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছি, শুরুতে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার, মাস্ক ব্যবহার দেখা গেলেও ক্রমেই সেটা রহস্যজনকভাবে কমে এসেছে। এ রকম আপনি দেখতে পাবেন স্থানীয় বাজারগুলোতে গেলে। আপনি দেখবেন ৬০ শতাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছে আর বাকি ৪০ ভাগ মানুষের চলাচল বেপরোয়া। তাঁরা মানছেন না সামাজিক দূরত্ব , মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। নিজে সচেতন না হলে সরকারের এত এত সুরক্ষাব্যবস্থা পুরোটাই ব্যর্থ হবে, যদিও আমরা দিন শেষে সরকারকেই দোষ দিই।

আজও আমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি, তবে তার পরক্ষণেই মনে হয় আজকে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কত হতে পারে? আগের দিনের থেকে কম নাকি বেশি? নিজের এলাকায় কেউ আক্রান্ত হলো না তো? এসব দুশ্চিন্তা সব সময়ই তাড়া করে বেড়ায়। মানুষের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য নেই, স্থবির হয়ে পড়েছে সবকিছু। সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। তবে করোনা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে, চাইলেই আশপাশের গরিব–দুঃখীদের কষ্ট লাঘব করতে পারি। চাইলেই সব ভেদাভেদ ভুলে বাঁচতে পারি। করোনা–পরিস্থিতিতে ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন ধনী থেকে শুরু করে উচ্চমধ্যবিত্ত ব্যক্তিরা পর্যন্ত। ডাক্তার, পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, সবাই নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে আমার আপনার নিরাপত্তার জন্য নেমে এসেছে রাস্তায়। আসুন না, নিজে ঘরে থেকে তাদের সহযোগিতা করি!

এখনো আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি সুস্থ এক পৃথিবীর, যেখানে আবার সবাই প্রাণ খুলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরবে। আমরা স্বপ্ন দেখি এমন একটি দিনের, যেদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে বলা হবে, আজ বাংলাদেশে কোথাও কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। আসুন আমরা সবাই নিজেকে বাঁচাই, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলি, নিজের পরিবারকে সুস্থ রাখি, অপরকে সুস্থ রাখি। সব সুরক্ষাব্যবস্থা শুধু জীবনের নিরাপত্তার জন্য। আমার আপনার সচেতনতাই পারে সুস্থ ও রঙিন বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনতে।

*শিক্ষার্থী: অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়[email protected]