করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রতিদিন নতুন জিনিস শিখছি: সেঁজুতি সাহা

সেঁজুতি সাহা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
সেঁজুতি সাহা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন নকশা উন্মোচন) হয়। এখন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে আছে সেঁজুতি। সেখান থেকে তাঁর গবেষণার নানা দিক সম্পর্কে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রথম আলো: আপনার নেতৃত্বে একটি দল বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জিন নকশা উন্মোচন করেছে। আপনার পুরো কাজটা নিয়ে শুরুতেই কিছু বলুন।

সেঁজুতি সাহা: আমি বাংলাদেশে এসেছি ২০১৬ সালে। শুরু থেকেই আমি জিনোম সিকোয়েন্সেই কাজ করতে চাই। ওই কাজের জন্যই আমি মূলত কানাডা থেকে পিএইচডির পরে দেশে ফিরে গিয়েছি। আমি যখন প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে কাজ শুরু করলাম, আমি কাজ করতান মেনিনজাইটিস নিয়ে। মেনিনজাইটিস হলো মস্তিষ্কের একটা রোগ। মেনিনজাইটিস হলে অনেক শিশু মারা যায়, কিন্তু তার থেকেও বেশি শিশু সারা জীবন পঙ্গু হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারি না, কোন জীবাণু দিয়ে এই মেনিনজাইটিস রোগটি হচ্ছে। এই জিনোম সিকোয়েন্সিং করেই আমি বুঝতে চাই কী জীবাণু দিয়ে মেনিনজাইটিস রোগটি হচ্ছে। ওখান থেকেই জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ শুরু। ২০১৮–তে জিনোম সিকোয়েন্সার মেশিন আমরা পেলাম, যেটা ব্যবহার করে বিভিন্ন রকমের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে থাকি। কখনো কোনো ব্যাকটেরিয়া করেছি বা ফাঙ্গাস করেছি। ২০১৯ সালের শেষে এসে আমরা ভাইরাসও সিকোয়েন্সিং করা শুরু করলাম। আমরা শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসগুলোকেই সিকোয়েন্সিং করা শুরু করেছি। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, আরএসভি (RSV) ভাইরাস। এগুলো করতে করতে আমাদের এক ধরনের অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে। এগুলো করতে করতে অবশ্য কখনো ভাবিনি যে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করব।

এ বছরের ২৯ মার্চ আমাদের ল্যাব অনুমতি পেল কোভিড-১৯–এর জন্য টেস্টিং ল্যাব হিসেবে কাজ করার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাদের অনুমতি দিলেন কোভিড টেস্টিং শুরু করার জন্য। কোভিড টেস্টিং শুরু করার কয়েক দিনের মধ্যে আমরা পজিটিভ কেস পেলাম। তখন থেকেই আমাদের মাথায় ঢুকল যে আমরা তো করোনাভাইরাসও সিকোয়েন্সিং করতে পারি। তখন আমরা দেখলাম যে দেশের বাইরে হাজার হাজার জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়ে যাচ্ছে। তারপর যখন দেখলাম যে ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল পর্যন্ত সিকোয়েন্সিং শুরু করে দিয়েছে, তখন একটা জেদ চলে এল। বাংলাদেশে সিকোয়েন্সিং হতেই হবে। এবং শেষ পর্যন্ত আমরা জিনোম সিকোয়েন্সিংটা করেছি। আমরা করেছি বলতে, পুরো দল করেছে। এখন ৮৩ জন কাজ করেন আমাদের দলে। আমাদের কাজ মূলত সংগৃহীত নমুনা টেস্ট করা।

আমরা স্যাম্পল সংগ্রহেও সহায়তা করে থাকি। পাশাপাশি শিশু হাসপাতালে আমরা শিশুদের নমুনা সংগ্রহের কাজও করি। সিকোয়েন্সিংয়ের একটা দল আছে আমাদের। এটা সাতজনের একটা দল। ওরা তো অনবরত কাজ করেই যাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সিএইচআরএফের সবাই অনেক সাহায্য করেছে জিনোম সিকোয়েন্সিংটা করতে।

প্রথম আলো: আমরা জানি যে ভবিষ্যৎ কোনো ওষুধ বা টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ভাইরাসের জিন নকশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিন নকশা উন্মোচনের গুরুত্ব নিয়ে কিছু বলুন।

সেঁজুতি সাহা: জিন নকশাটা উন্মোচন করা কেন গুরুত্বপূর্ণ? দেখুন আমরা এটা জানি যে কোভিড-১৯ হয় নভেল করোনাভাইরাস বা সার্স কোভিড–২ দ্বারা। ৯ জানুয়ারি প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিংটা না হলে আমরা এই ভাইরাসটাকে চিনতে পারতাম না। আমরা জানতাম যে কোভিড–১৯ নামে একটা রোগ হচ্ছে, নিউমোনিয়ার মতো। কিন্তু কী ভাইরাস দিয়ে হচ্ছে, সেটা কিন্তু ওই জিনোম সিকোয়েন্সিং দিয়েই জেনেছি। আমরা যে এখন এতে পিসিআর করি, এই পিসিআরগুলোর ডিজাইনগুলোও করা হয়েছে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য ব্যবহার করে।

আর এই যে এখন এতগুলো টিকা তৈরি হচ্ছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে, এগুলোর ডিজাইনের জন্য জিনোম সিকোয়েন্সিং দরকার। বাংলাদেশে এর গুরুত্ব এ জন্য যে যেকোনো ভাইরাস আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনগুলোকে আমরা বলি মিউটেশন। এই নতুন টিকাগুলো আসলে কাজ করবে কি না বা কীভাবে নতুন টিকা ডিজাইন করতে হবে, এগুলোর জন্য তো জিন নকশাটা জানা খুব দরকার। যে টিকাটা যুক্তরাষ্ট্রে বা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে তৈরি হচ্ছে, সেটা কি বাংলাদেশেও আদৌ কার্যকর হবে কি না—এসব বোঝার জন্য বাংলাদেশে যে ভাইরাসগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেগুলোর জিনোম সিকোয়েন্সিং করাটা খুবই জরুরি।

প্রথম আলো: আপনারা যে ভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্সিং করলেন, তার সঙ্গে অন্য কোনো দেশের ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যের সামঞ্জস্য দেখলেন?

সেঁজুতি সাহা: হ্যাঁ আমরা দেখেছি। শুধু আমরাই না, বেশ কয়েকটি দল জিনোম সিকোয়েন্সিং করা শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের দেশে যে ভাইরাসগুলো এসেছে, তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। ইউরোপ থেকে কিছু ভাইরাস এসেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকেও এসেছে। এটা বিস্ময়কর কিছু না। কারণ, ভাইরাসটা নিশ্চয়ই একজন মানুষের মাধ্যমে ঢোকেনি বাংলাদেশে। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন মানুষ এসেছে। তাদের সঙ্গে ভাইরাসটিও এসেছে।

প্রথম আলো: আপনাদের কাজের পর অনেক প্রতিষ্ঠানই জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিকোয়েন্সিং করেছে। এগুলো কি দেখার সুযোগ হয়েছে আপনার?

সেঁজুতি সাহা: দেখার সুযোগ পেয়েছি। আর এতে অসম্ভব খুশি লাগছে, বিভিন্ন দল সিকোয়েন্সিং করেছে। এই যে গতিটা, এটা দেখে খুব ভালো লাগছে। এতে মনে হচ্ছে, আমাদের ওপর থেকে বোধ হয় একটু চাপ কমেছে। আমাদের দেশে যত বেশি দল সিকোয়েন্সিং করবে, তত ভালো। আর বিভিন্ন দল যখন সিকোয়েন্সিং করছে ওরা কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে। যত আমরা বিভিন্ন জায়গার নমুনা সিকোয়েন্সিং করব, তত আমরা এই ভাইরাসগুলোকে বুঝতে পারব। ঢাকার ভাইরাসগুলোর মিল আছে ইউরোপের ভাইরাসগুলোর সঙ্গে বেশি আর চট্টগ্রামের সিকোয়েন্সড কিছু ভাইরাসের মিল আছে মধ্যপ্রাচ্যের ভাইরাসগুলোর সঙ্গে। এগুলো খুবই আগ্রহোদ্দীপক। যত বেশি সিকোয়েন্সিং হবে, আমরা তত বেশি কিছু শিখতে পারব।

প্রথম আলো: এটিকে বলা হচ্ছে নতুন বা নভেল করোনাভাইরাস। যতটুকু পত্রপত্রিকা পড়ে দেখেছি যে বিজ্ঞানীরাও এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। এর আচরণটা ঠিক সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না। যেমন আমরা শুনেছিলাম যে এটি শিশু বা কম বয়সীদের জন্য খুব মারাত্মক হবে না। বয়স্ক এবং ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্তদের জন্য বেশি ক্ষতিকর হবে। কিন্তু আমরা দেখছি বাংলাদেশেই কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত এবং মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের বয়স ৩০–এর নিচে। এ অবস্থাটা কেন হচ্ছে?

সেঁজুতি সাহা: আমরা আসলে প্রতিদিন ভাইরাসটা সম্পর্কে নতুন নতুন জিনিস শিখছি। আমাদের দলের মধ্যে আমরা একটা কথা বলি, এখন যেন প্রতিদিন ২৪টি দিন পার করছি। ২৪ ঘণ্টায় যেন ২৪টি জিনিস আমরা শিখেই যাচ্ছি। একটা ব্যাপার সত্যি যে অনেক কম বয়সী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ৩০ বা ৪০ বছরের অনেকে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে মারাও যাচ্ছে। এটার কারণ আমরা এখনো ভালো করে বুঝতে পারি না, কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য বা কাঠামো আপনাকে মনে রাখতে হবে। আমরা আমাদের জনসংখ্যার কাঠামোকে যদি ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে আমাদের জনসংখ্যার বড় অংশের বয়স ২৫ থেকে ৫৫। ইতালিতে অনেক সংখ্যক মানুষ ৬০–এর ঊর্ধ্বে। এভাবে যদি আমরা চিন্তু করি তাহলে কোভিড রোগ আক্রান্তের ক্ষেত্রে ওসব দেশের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই ভিন্নতা থাকবে। তা ছাড়া কাদের বেশি আক্রন্ত করবে কাদের মধ্যে রোগটা গুরুতর হবে, এটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। শুধু ভাইরাসটার ওপরেই না। আমাদের জনবসতি, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের চলাফেরা, কত মানুষের সঙ্গে কাজ করছি, আমাদের বাসস্থানের আকার আবার আমাদের রোগ প্রতিরোধী শক্তি বা ইমিউনিটি কেমন এর ওপরও নির্ভর করে।

প্রথম আলো: একটা কথা শোনা যাচ্ছিল যে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে করোনাভাইরাস এত বেশি মারাত্মক হবে না। যদি ইউরোপ ও আমেরিকার শীতপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি, সে ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এসব দেশে করোনা তাহলে কম করে ছড়াচ্ছে বা ছড়াবে?

সেঁজুতি সাহা: আমরা যদি আক্রান্তের সংখ্যা তুলনা করি ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে, তাহলে আমাদের সংখ্যা কমই দেখছি। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না আমাদের টেস্টও কম হচ্ছে। আমরা যত টেস্ট কম করব, আমাদের কেস তত কম মনে হবে। তবে এরপরও আমাদের এখন পর্যন্ত যত তথ্য আছে, তাতে মনে হচ্ছে, আমাদের এখানে রোগের তীব্রতা হয়তো কম বা হয়েতো বেশি করে ছড়াচ্ছে না। কেন এমন হচ্ছে, সেটা বলা খুব কঠিন। আবার আগের কথায় আসতে হয়। আমাদের দেশের জনসংখ্যার কাঠামো আলাদা। আমরা কিন্তু দেখেছি, রোগটা অনেক বেশি গুরুতর হয় ৬০–এর ঊর্ধ্বের মানুষের। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ ২৫ থেকে ৫৫–এর মধ্যে। আমরা আমাদের দেশকে নবীন দেশ বলি, তাই হয়তো আমাদের প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি। রোগটা হয়তো বড় আকারে ছড়াতে পারছে না। আমাদের তরুণ যে জনগোষ্ঠী, তাদের হয়তো ইমিউনিটি বেশি। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে, এটা আরও কিছুদিন গেলে বোঝা যাবে। তাপমাত্রার সঙ্গে সরাসরি কোনো সংযোগ আছে কি না। এটা নিয়ে এখন অনেক গবেষণা চলছে।

প্রথম আলো: ভাইরাসের মিউটেশন বা গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন এটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কীভাবে হয়েছে বা কতটুকু হয়েছে? এই পরিবর্তনের প্রভাবটা কী? অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের সঙ্গে আমাদের দেশে ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কী দেখেছেন আপনারা? বাংলাদেশে ভাইরাস কি আরও আগ্রাসী আচরণ করছে?

সেঁজুতি সাহা: সব ভাইরাস পরিবর্তিত হয়। কিছু ভাইরাস তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হয়, কিছু কম গতিতে। উদাহরণস্বরূপ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হয়। এত তাড়াতাড়ি এর মিউটেশন হয় যে প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য নতুন টিকা লাগে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে মিউটেশনের হারটা বেশি না। মনে করা হচ্ছে যে একটা ভাইরাস মাসে দুবার করে মিউটেট করে। আমাদের দেশেও আমরা যে মিউটেশন দেখছি, আমরা প্রাকৃতিকভাবে যে পরিবর্তন ধারণা করেছিলাম, তেমনটাই দেখেছি। আমাদের দেশের ভাইরাসগুলোর সঙ্গে ইউরোপের এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভাইরাসের মিল আছে। এটা কিন্তু ভালো খবর। ভাইরাস যত কম পরিবর্তন হবে এবং কম বিচিত্র নিয়ে আসবে, যে টিকাগুলো তত কার্যকর হবে। ভাইরাস যদি খুব বেশি পরিবর্তন হয়ে যায় যে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলছেই না, তাহলে কিন্তু আমাদের সমস্যা। কিন্তু এখন পর্যন্ত লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন দেখছি না। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলছে। আর একটা ভাইরাস আগ্রাসী না দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তা আসলে বলা কঠিন। অনেকে অনেক রকম অনুমাননির্ভর কথা বলেন। কিন্তু হুট করে এভাবে বলা যায় না। ল্যাবরেটরিতে অনেক পরীক্ষা করতে হয়। আর অনেক রকমের তথ্য উদঘাটন করতে হবে এ কথাগুলো ভালো করে বোঝার জন্য।

প্রথম আলো: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করছে। আপনারাও একে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু একটি ছাতার নিচে এসব কাজ করলে কি বেশি সুবিধা হতো না? সরকারিভাবে বৃহৎ আকারে উদ্যোগ নেওয়া যেত না?

সেঁজুতি সাহা: এখানে যা হচ্ছে, তা দেশের মধ্যেই হচ্ছে। আমরা অনেক সময় দেখি নমুনাগুলো বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য। ওটা কিন্তু আমরা এবার দেখছি না। আমরা একটা উদ্দাম দেখছি সিকোয়েন্সিং করার জন্য। মানুষ বুঝতে পারছে, দেশে বসেই আমরা জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে পারি। বাংলাদেশে সিকোয়েন্সিং হচ্ছে, সেটাই বড় কথা। যে জায়গাতেই সিকোয়েন্সিং করুক না কেন, সব সিকোয়েন্সিংয়ের ডেটা কিন্তু এক জাগাতেই জমা হয়। আমরা সবাই সবার সিকোয়েন্সিং দেখতে পাই। সবাইকে এক ছাতার নিচে কাজ করার চেয়ে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। মাত্র কয়েকটা সপ্তাহ হলো আমাদের দেশে সিকোয়েন্সিং শুরু করেছি। সমন্বয় অবশ্যই আসবে। আমরা চাই বা না চাই, একসঙ্গে কাজ করতে আমরা বাধ্য। বাইরের দেশগুলোতে যারা টিকার জন্য কাজ করছে, তারা যখন সিকোয়েন্সিং দেখছে তারা কিন্তু এটা ভাবছে না এটা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। তারা শুধু জানছে এটা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। সিকোএন্সিংয়ের এই গতি এবং উদ্যোগগুলোকে ধরে রাখতে হবে।

সেঁজুতি সাহা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
সেঁজুতি সাহা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া


সেঁজুতি সাহা: বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের বেশ সীমাবদ্ধতা আছে। যদি জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কথাটাই ধরি দেখা যাচ্ছে যে অনেক দেশ শত শত সিকোয়েন্সিং করে ফেলেছে আগেই। গবেষণার সীমাবদ্ধতা কাটানো যায় কীভাবে?

সেঁজুতি সাহা: আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যেকোনো নিম্ন বা মধ্য আয়ের দেশে অবশ্যই অনেক রকমের সীমাবদ্ধতা আছে। এরপরও আমরা কাজ করছি। আমরা এগোচ্ছি। এখন করোনাভাইরাস নিয়ে কথা হচ্ছে কিন্তু আমরা জানি আমাদের দেশে পাটের সিকোয়েন্সিং হয়েছে। ইলিশ মাছের জেনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে। আমরা এর আগে অনেক রকমের জেনোম সিকোয়েন্সিং করেছি।

কিন্তু আমাদের দেশে যত সিকোয়েন্সিং মেশিন আছে, ওই তুলনায় অত বেশি সিকোয়েন্সিং হয় না। কারণ কারিগরি দক্ষতার কিছুটা হলেও ঘাটতি আছে। আমি অনেক বেশি সৌভাগ্যের অধিকারী, আমি বাইরে পড়াশোনা করতে পেরেছি। শিখছি অনেক কিছু। বাংলাদেশে এসে একটা দল গঠন করতে পেরেছি, যারা জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে পারে। আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সিকোয়েন্সিংয়ের খুঁটিনাটিগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শেখাতে হবে।
সিকোয়েন্সিং মেশিনের মডেলগুলো কিন্তু ফোনের মডেলের মতোই চেঞ্জ হতে থাকে। প্রতিনিয়ত আমরা যদি মেশিনগুলোকে ব্যবহার না করি, তাহলে নতুন মেশিনগুলো ব্যবহার করাটা আরও কঠিন হয়ে যাবে। এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো, যেসব সরঞ্জাম বা রিএজেন্টস লাগে, এগুলোর অভাব আছে। এগুলো পেতে অনেক দিন সময় লাগে। এর একটা কারণ অবশ্যই এটা যে আমাদের চাহিদা কম। কিন্তু এখন যে সিকোয়েন্সিং শুরু হয়েছে, এতে আমাদের দেশে একটা বাজার সৃষ্টি হবে। বাজার থাকলে চাহিদা বাড়বে, চাহিদা বাড়লে জোগান তো বাড়াতেই হবে। মূল কথা হলো, যে গতিটা এখন এসেছে তা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখন করোনাভাইরাসের সিকোয়েন্সিং করছি ভবিষ্যতে অন্য কিছুর করব।

প্রথম আলো: জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পর নিশ্চয়ই আপনার কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত কী ধরনের গবেষণা করছেন?

সেঁজুতি সাহা: আমাদের মূল কাজ হলো করোনাভাইরাস টেস্ট করা। কোভিড–১৯–এ আক্রান্তদের নমুনাগুলো আমাদের পাঠানো হয়, সেগুলো আমরা টেস্ট করে দিই। আমরা নিজেরাও কিছু অনেক জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করি। শিশু হাসপাতালের সঙ্গে কিছু কাজ করছি, অন্য হাসপাতালগুলোকে নমুনা সংগ্রহে সহায়তা করছি। সংগ্রহের জন্য অনেক হাসপাতালকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি আমরা। রোগীর পরিষেবাই আমাদের প্রধান কাজ। এটা করে যদি আমরা সময় পাই, তখনই শুধু আমরা সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ করি। আমাদের জন্য খুব ভালো হয়েছে যে এতগুলো দল বাংলাদেশে কাজ করছে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য। আমাদের সময়টা খুব কম। সারা দিন আমাদের ল্যাব খোলা থাকে। আমাদের দলের সবাই সারা দিন নমুনার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রাতে সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ করে। নতুন নতুন পদ্ধতি এসেছে, আমরা সেগুলোকে অপটিমাইজ করছি। এটা ছাড়াও আমরা করোনাভাইরাস নিয়ে আরও কিছু কাজ করছি। আমরা এই যে টেস্টগুলো করছি, এগুলো কীভাবে আরও কম সময়ের মধ্যে করা যায়, এটা নিয়ে অনেক রকমের কাজ করছি। ল্যাবে টেস্ট করতে যত কম সময় লাগবে, রোগীরা তত তাড়াতাড়ি রিপোর্ট পাবেন।

আমরা বিভিন্ন হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছি। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি যে তাদের মধ্যে কোভিড–১৯ সংক্রমণের হার কত। শতকরা কতজন আক্রান্ত হচ্ছেন এবং হওয়ার পরে কয়দিন ধরে ভাইরাসটা তার বা তাদের শরীরে থাকছে। আমরা শিশুদের কোভিড–৯ আক্রান্ত হওয়া নিয়েও কাজ করছি।

আমাদের দলটা কিন্তু শুধু ল্যাবরেটরি-কেন্দ্রিক একটা দল না। আমরা একটা বহুমাত্রিক দল। আমরা জিনোম সিকোয়েন্সিং করি কিন্তু পাশাপাশি শিশুদের বিভিন্ন সংক্রামক রোগ–সংক্রান্ত অনেক রকমের কাজ করি। এ ছাড়া একটা রোগের জন্য কী কী শারীরিক এবং সামাজিক সমস্যা হতে পারে, এগুলো নিয়েও আমরা অনেক কাজ করি। আমরা এত দিন ধরে এমন যত কাজ শিখেছি বা করেছি, তার সবই করোনাভাইরাসের জন্য প্রযোজ্য হবে।