'নিজের হাতে নিজেই ফ্লুইড দিলাম'

চিকিৎসক নীলিমা নার্গিস। ছবি সংগৃহীত
চিকিৎসক নীলিমা নার্গিস। ছবি সংগৃহীত

'সব মিলিয়ে দিন দিন খারাপ হতে থাকলাম। বিভিন্ন উপসর্গের পাশাপাশি ব্লাডপ্রেশার কমতে শুরু করে। দিনে ছয় থেকে সাটা ওরস্যালাইন আর ডাবের পানি খাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, আমার অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আর না পেরে হাজব্যান্ডকে বললাম ক্যানুলা করার কথা। কিন্তু করোনা পজিটিভ রোগী, কেউ ক্যানুলা করতে রাজি না। চিকিৎসক স্বামী পিপিই পরে এসে নিজেই ক্যানুলা করে দিল। তাতে ব্লকহোলে বাটারফ্লাই দিয়ে নিজের হাতে নিজেই ফ্লুইড দিলাম। ওই দিন ছিল আমাদের সপ্তম বিবাহবার্ষিকী।’

কথাগুলো বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক নীলিমা নার্গিস। এফসিপিএসের (ফাইনাল পার্ট) এই চিকিৎসক বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগে কর্মরত। করোনার রিপোর্ট পজিটিভ (কোভিড ১৯) আসার পর তিনি বাসায় চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ১৯ মে তাঁর দুটো রিপোর্ট করোনা নেগেটিভ এসেছে। তারপরও পাতলা পায়খানাসহ কিছু জটিলতা থাকায় তিনি তাঁর রুমেই একা ছিলেন। ঘর থেকে বের হন ২৬ মে। এখনো মাস্ক পরে থাকাসহ অন্যান্য নিয়ম মেনে চলছেন। দীর্ঘ এক মাসের বেশি কোয়ারেন্টিন বা বন্দিজীবন কাটিয়ে আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছেন। টেলিফোনে কথা হয় এ চিকিৎসকের সঙ্গে। জানালেন, দুর্বলতার কারণে এখন ঘুম বেশি হচ্ছে। নীলিমা নার্গিসের আগে থেকেই অ্যাজমা ছিল। বুকে ব্যথা, কাশি, ডায়রিয়া, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অরুচি, হাত–পা–মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথাসহ করোনার বিভিন্ন লক্ষণ দেরিতে শুরু হয়। রক্তশূন্যতাও ছিল। পালস অক্সিমিটার, অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় এনে রাখা ছিল আগে থেকেই।

নীলিমা নার্গিস জানান, ২২ এপ্রিল তাঁর শিশু (কিডনি) বিভাগে নাইট ডিউটি ছিল। রাত ১০টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা রোগীর রিপোর্ট হাতে আসে। করোনা পজিটিভ। ওই রোগীকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে রেফার করা, অন্য রোগীদের ব্যবস্থাপনাসহ সব করতে করতে সকাল আটটা বেজে যায়। পরে ওয়ার্ড লকডাউন করা হয়। সবকিছু শেষ করতে করতে ১৮ ঘণ্টা পার হয়ে যায়। তখনই তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর করোনা পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নীলিমা বললেন, ‘চাইলেই আমি পারতাম অন্য রোগীদের ফেলে আমার ডিউটি টাইমে সকাল আটটায় বাসায় চলে যেতে। না পারিনি। আমার রোগীর জন্য আমার ভালোবাসা। বাসায় বলে রেখেছিলাম, আইসোলেশনের রুম রেডি রাখতে। সেদিনই বন্দিজীবনের শুরু।'

রাজধানীতে নীলিমা তাঁর শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর, ননদের বাচ্চা, নিজের ৬ বছর ২ মাস বয়সী সন্তানসহ সবাই যৌথ পরিবারে থাকেন। তাঁর স্বামী ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের অ্যাসিসট্যান্ট রেজিষ্ট্রার মো. বায়েজিদুর রহমান। লকডাউনের শুরু থেকেই তাঁরা স্বামী–স্ত্রী নিয়মিত যাঁর যাঁর কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই যেকোনো সময় তাঁদের করোনা পজিটিভ হতে পারে, সে সম্ভাবনা মাথায় রেখে যতটুকু সম্ভব সচেতনভাবে চলেছেন। নিজের সন্তানসহ বাসার অন্য সদস্যদেরও মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

নীলিমা বললেন, ‘করোনার যে অভিজ্ঞতা, তা ভয়াবহ। হাসপাতালে নিজে বাচ্চাদের ক্যানুলা করি। আর নিজের যখন প্রয়োজন তখন অন্যরা ভয়ে আমার কাছে আসতে চায়নি। স্বামী পিপিই পরে ক্যানুলা লাগিয়ে দিয়ে যায়। পাতলা পায়খানার জন্য বারবার বাথরুমে যাওয়াসহ অন্যান্য কাজ নিজেকেই করতে হয়েছে। তারপর ক্যানুলার মধ্যে ঝামেলা হলে স্বামীকে আর ডাকিনি। নিজের হাতে নিজে ক্যানুলা লাগানো দুঃসাহসিক কাজ, কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য তা–ও করেছি।’

নীলিমা নার্গিস বলেন, ‘করোনা পজিটিভ আসার পর থেকে পাগল পাগল অবস্থা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতেও পারি আবার মারাও যেতে পারি। সব থেকে ভয় লাগত পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা চিন্তা করে। আমি বা আমার স্বামী চাকরি করছি, আমাদের কিছু হলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের জন্য অন্য কারও করোনা হলে বা কাউকে হারাতে হলে...এই চিন্তায় অস্থির থাকতে হয়েছে। দেড় বছর হলো আমার বাচ্চার হার্টের অপারেশন হয়েছে। ওকে নিয়ে ভয়, ননদের বাচ্চা, শ্বশুর–শাশুড়ি সবাইকে নিয়েই ভয় কাজ করত।’

যৌথ পরিবারের সদস্য হয়ে করোনা রোগী হিসেবে বাড়তি যে সুবিধাগুলো পেয়েছেন, তার জন্য নীলিমা পরিবারের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বললেন, ‘রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমি আমার রুমে যতক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে রাখতাম, রুমের সামনে ডাইনিংয়ে বসে সে সময় আমার শাশুড়ি কোরআন পড়তেন আর আমার জন্য দোয়া করতেন। আমার দেবর রুমের সামনে খাবার দিয়ে যেত, খাওয়ার পর আমি ভেতর থেকে তা ধুয়ে বাইরে রাখার পর আমার দেবর তা নিয়ে যেত।’

করোনাভাইরাসের পাশাপাশি একজন রোগীকে অনেক কিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় উল্লেখ করে ৩৩তম বিসিএসের এ চিকিৎসক বলেন, ‘ঢাকা শহরেই আমার মা–বাবা থাকেন। তাঁরাও অসুস্থ। তাই তাঁদের সঙ্গে ভিডিও কলে একদম সুস্থ আছি সেভাবে কথা বলতে হয়েছে। অথচ তত দিনে আমার চোখ প্রায় গর্তে ঢুকে গেছে। দাঁড়িয়ে নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারছিলাম না।কিন্তু কেউ যাতে বাইরে থেকে তা বুঝতে না পারে, সে যে কী মানসিক যুদ্ধ, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।’ তিনি বললেন, ‘মানসিক শক্তি, মনোবল, আত্মবিশ্বাস থাকা জরুরি। ব্যায়াম করেছি। নামাজ পড়েছি। কোরআন পড়েছি। মন ভালো রাখার জন্য নাটক দেখেছি। মেয়ে দরজার নিচ দিয়ে চিঠি পাঠাত। তা পড়ে ম্যাসেঞ্জারে উত্তর লিখতাম।’

কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় নীলিমা ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘পাশের রুমে মেয়ে দাদির কাছে। প্রথম রাতটা খুব কষ্টে কাটিয়েছি। আমি খুব কম কাঁদি। সেদিন রাতে রায়ার জন্য চোখের জল থামাতেই পারছিলাম না। ওকে আমি যে গান গেয়ে শোনাই, তা মনে করতেই বুক ফেটে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে শক্ত হলাম। আমাকে দূরে থাকতেই হবে। ২৯ এপ্রিল আমার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। আমি আমার জীবনে কঠিন সময় পার করেছি, নিজ হাতে রায়াকে অপারেশন টেবিলে রেখে আসছিলাম। ওই দিন থেকে আমি পাথর হয়ে গেছি। সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় আমাকে আল্লাহ জয়ী করেছেন। আর কোভিড–১৯–কে কিসের ভয়।’