করোনা মোকাবিলার উদ্যোগে সরকারের ভেতর-বাইরে সমন্বয়হীনতা

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনা–পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ভেতরে ও বাইরে সমন্বয়হীনতা আছে। এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্য মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। আবার সরকারের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালের কোনো সমন্বয় ঘটছে না। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতির মধ্যে ছুটি শিথিল করে দেওয়ায় মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা প্রবল। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিভিন্ন খাতের সঙ্গে সরকারের সমন্বয় জরুরি। সামাজিক সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। 

‘সাধারণ ছুটি–পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে এসব কথা বলেন বিশিষ্টজনেরা। আজ সোমবার সকালে এ সংলাপের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ। সংলাপে মহামারি বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, করোনা বিষয়ে সরকারের তৈরি একাধিক কমিটির বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, সাংসদ, জনস্বাস্থ্যবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যক্তিরা অংশ নেন।
আলোচনার শুরু করেন এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার বৈশ্বিক বিস্তারকে ‘প্যানডেমিক’ বলেছে। এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘মহামারি’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্যানডেমিকের প্রতিশব্দ ‘অতিমারি’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অতিমারি আসলে মহামারির চেয়েও বড় কিছু।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কথিত সাধারণ ছুটি শিথিল করার পর এই অতিমারির অভিক্ষেপ কী এবং এর মোকাবিলায় কী প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, তা জানাই এই সংলাপ আয়োজনের উদ্দেশ্য।
অনুষ্ঠান সঞ্চলনা করেন আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম।
আজ চারজন নির্ধারিত বক্তা শুরুতে তাঁদের বক্তব্য দেন। এর মধ্যে প্রথমেই এসডিজি প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপের সদস্য এবং বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্যবিদ মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় লকডাউন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ছিল যথেষ্ট। তবে সরকার চাইলেও বাংলাদেশের মতো দেশে লকডাউন পুরোপুরি বাস্তবায়ন অসম্ভব বলে মনে করেন তিনি। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কয়েকটি প্রস্তাব দেন মোশতাক চৌধুরী। তিনি বলেন, লকডাউন বা ছুটি ঢালাওভাবে তুলে না নিয়ে সীমিতভাবে তুলতে হবে। সংক্রমণের ব্যাপকতার নিরিখে দেশের মধ্যে জোনিং করতে হবে। দেশের সব জেলায় সংক্রমণের হার এক নয়। যেখানে অপেক্ষাকৃত কম সংক্রমণ ঘটেছে এমন জেলার সবকিছু পুরোপুরি খুলে দেওয়া যেত। কিছুদিন দেখা যেত কোথায় ঝুঁকি আছে, কোথায় সমস্যা আছে।
মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে করোনার টেস্ট হয়েছে ১ হাজার ৮৭৭টি। ভারত ও পাকিস্তানে এ হার যথাক্রমে ২ হাজার ৭০০ এবং ২ হাজার ৫০০। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে টেস্ট সবচেয়ে কম। এ হার বাড়াতে হবে।
মোশতাক চৌধুরী বলেন, করোনা মোকাবিলায় কোনো সামাজিক প্রয়াস নেই বাংলাদেশে। প্রতিটি গ্রামে করোনা মোকাবিলায় কমিটি গঠন করতে হবে। সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরামর্শক গ্রুপ তৈরি করতে হবে।
করোনা মোকাবিলয়া সরকারের এক অপ্রকাশ্য কৌশল গোষ্ঠীগত রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতা বা হার্ড ইমিউনিটি। এটা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কতটুকু সম্ভব? অনুষ্ঠান সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাব দেন খ্যাতিসম্পন্ন টিকা বিশেষজ্ঞ এবং আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরি। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাত্র পাঁচ মাস হয়েছে। হার্ড ইমিউনিটি আমরা ভাবতে পারি অন্য অসুখের জন্য। কিন্তু কোভিড–১৯–এ যেসব উপসর্গ তৈরি হয়, তাতে ১০ শতাংশ বা বেশি লোকের অবস্থা জটিল হয়ে থাকে। তাই এর ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটির একটা ঝুঁকি আছে। এটা কিছু লোকের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।’
অধ্যাপক কাদরি বলেন, ‘ভাইরাসকে বোঝার জন্য বিস্তর গবেষণা দরকার। যাদের রোগ হয়েছে তাদের মধ্যে কী ধরনের বিষয় কাজ করেছে। আমি গবেষণায় দেখেছি, যারা এখনো আক্রান্ত হয়নি, তাদের অ্যান্টিবডির মাত্রা শূন্য। কিন্তু আমাদের এটা ক্রমাগত দেখতে হবে তিন মাস পর, ছয় মাস পর বা তিন বছর পরও। দেখতে হবে আমাদের প্রতিরোধীশক্তি কতটুকু অর্জিত হলো। গবেষণার ক্ষেত্র থেকে রোগটিকে ভালোভাবে বুঝতে হবে।’
করোনা–পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আট বিভাগে যে আটজন বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে একটি দল গঠন করেছে, তার একজন আবু জামিল ফয়সাল। তিনি সিলেট বিভাগের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, সরকারের একেক মন্ত্রণালয়ের একেক রকম নির্দেশনা আসছে। এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বিস্তর। আসলে একধরনের প্রশাসনিক প্যানডেমিক শুরু হয়েছে। সমন্বয়ের অভাব আছে যথেষ্ট। মোকাবিলার কাজে ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক সম্পৃক্ততা হয়নি। সামাজিক সম্পৃক্ততার একটি সফল উদাহরণ রাজধানীর টোলারবাগ। ক্লাস্টারভিত্তিক এমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
আবু জামিল ফয়সাল বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। পোশাক কারখানাকে নির্দেশ দিয়ে এক কোটি মাস্ক সরকার বানিয়ে নিতে পারত। দেশে ১০৮টি ওষুধ কারখানা আছে। তাদের কাছে থেকে স্যানিটাইজার বানিয়ে নিয়ে, তা বিনা মূল্যে বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া যেত।
চিকিৎসক ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য রওশন আরা বেগম বলেন, করোনার এই সময় মাতৃস্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে ব্যাপকভাবে। দেশে প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ শিশুর জন্ম হয়। এর অর্ধেকই হয় বাড়িতে। এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবা কমায় আরও অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ প্রসব হচ্ছে ঘরে। এতে মাতৃমৃত্যু এবং সেই সঙ্গে ফিস্টুলার মতো রোগের ঝুঁকি রয়ে গেছে। পরে এসব সমস্যা আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠবে।
রওশন আরা বেগম বলেন, লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিবার পরিকল্পনার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে।
চিকিৎসক এম এইচ চৌধুরী কোভিড–১৯ রোগীর চিকিৎসায় সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে ২ লাখ ৭০ হাজার শয্য আছে। এর দুই–তৃতীয়াংশই বেসরকারি হাসপাতালের। আর ৯০ হাজার চিকিৎসকের মধ্যে ২৬ থেকে ২৭ হাজার সরকারি চিকিৎসক। বাকিরা বেসরকারি বা ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা করেন। কিন্তু প্রথম থেকেই বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে দূরে রাখা হয়েছে। হাসপাতালগুলো কোভিড ও নন–কোভিড করে বড় ভুল করা হয়েছে। এতে মানুষের চিকিৎসা সহায়তা আরও সংকুচিত হয়ে গেছে। এম এইচ চৌধুরী বলেন, এক ভাগ এখন লকডাউনের পরিমাণ ১৫ দিন বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। আর র‍্যাপিড টেস্টিং শুরু করতে হবে জোরদারভাবে।

বেসরকারি সংগঠন দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক দিবালোক সিংহ বলেন, দেশের বস্তিগুলোতে করোনার সংক্রমণ এখনো খুব বড় আকারে হয়নি। তিনি করোনার মোকাবিলায় ভারতের কেরালা ও ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করেন।
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক মোরশেদা চৌধুরী গবেষণার উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক অনটনের কারণে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ৩২ শতাংশ। নিম্ন আয়ের নারীদের মধ্যে মাস্ক পরার হার মাত্র ৩৫ শতাংশ কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ৭০ শতাংশ।
আজকের আলোচনায় করোনা পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের চিত্র উঠে আসে বরগুনা জেলা হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মো. কামরুল আজাদের বক্তব্যে। তিনি বলেন, কোনো করোনা রোগী এলে তাঁর নমুনা সংগ্রহ করে বরিশালে পাঠাতে হয়। এর ফলাফল আসতে পাঁচ দিন লেগে যায়। কিন্তু আমার কাছে যেদিন রোগী আসে উপসর্গ দেখে সেদিনই চিকিৎসা করতে হয়। এই পাঁচ দিন অপেক্ষা করলে রোগী বেঁচে থাকতে পারেন বা তাঁর মৃত্যুও হতে পারে।
আলোচনায় সাংসদ অ্যারোমা দত্ত আরও টেস্ট বাড়ানোর তাগিদ দেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সমন্বয়হীনতা কাটানোর উদ্যোগের তাগিদ দেন।
আজ আলোচনা করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ নাজমে সাবিনা, ব্যবসায়ী নেতা আসিফ ইব্রাহিম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রমুখ।