৮ মার্চের সেই বিকেল

আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। ফাইল ছবি
আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। ফাইল ছবি
>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

করোনা নামক ভাইরাস এই পৃথিবীতে হানা দিয়েছে, তা অনেক আগেই জেনেছি। প্রতিদিন বিভিন্ন চ্যানেলের সংবাদে এবং ফেসবুকের নিউজফিডে এ নিয়ে অনেক তথ্য দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হবে জুলাই মাসে, হাতে এখন অনেক সময়। তাই আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলনটাও দেখছি নিয়মিত। কীভাবে চীন থেকে এ ভাইরাস ধীরে ধীরে অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে, তা–ও দেখছি।

মার্চের শুরুতে প্রতিদিন যখন আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলন শুরু হয় তখন ভাবি, এই বুঝি মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ঘোষণা দেবেন বাংলাদেশের প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলো। তারপর যখন সংবাদ সম্মেলন শেষ হয় আর মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এমন কোনো ঘোষণা দেন না, তখন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। আর মনে মনে ভাবি, যাক এই ভয়াল ভাইরাস এখনো আমাদের দেশে আঘাত হানেনি।

এমন করেই দিন কেটে যাচ্ছিল। প্রতিদিন আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলন দেখছি আর শেষে যখন শুনতে পাই দেশ এখনো করোনামুক্ত, তখন মনে শান্তি পাই।

কিছুদিন হলো একটা তথ্য জানতে পেরেছি। ১৭২০, ১৮২০ ও ১৯২০ সালেও নাকি পৃথিবীতে এমন মহামারি দেখা দিয়েছিল। অর্থাৎ ১০০ বছর পরপর এমন মহামারি হচ্ছে। আর তাতে মারা গেছে লাখো মানুষ।
১৭২০ সাল—প্লেগ রোগ
১৮২০ সাল—কলেরা
১৯২০ সাল—স্প্যানিশ ফ্লু
২০২০ সাল—করোনাভাইরাস

একটি থেকে আরেকটি ১০০ বছর পরপরই এসেছে।

ভাবতে থাকি, যদি করোনাভাইরাস আগের মহামারিগুলোর মতো ব্যাপক আকার ধারণ করে, তাহলে কী হবে পৃথিবীর? কী হবে বাংলাদেশের?

আবার পরমুহূর্তে এটা ভেবে একটু শান্তি পাই যে বাংলাদেশে তো এখনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। কিন্তু সে শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হলো না।

দিনটা ছিল ৮ মার্চ। দিনের শুরুটা সুন্দর ছিল, সুন্দর সকাল, সুন্দর আবহাওয়া। তো যথারীতি আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলন শুরু হলো। আমিও টিভির সামনে বসে গেলাম। যেহেতু বিগত অনেক দিন থেকে শুনে অভ্যস্ত হয়েছি, বাংলাদেশে এখনো কোনো করোনা রোগী পাওয়া যায়নি, তাই হঠাৎ করে যখন মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বললেন, বাংলাদেশে তিনজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন; তখন মনে হলো একটা ধাক্কা খেলাম। তাহলে অবশেষে আমরাও এই মহামারির কবলে পড়ে গেলাম! এটাই ভাবতে শুরু করলাম। ওই দিন বিকেলবেলা বাজার থেকে চারটা মাস্ক কিনলাম। যেহেতু এর আগে বাংলাদেশে করোনা রোগী পাওয়া যায়নি, তাই মাস্ক কেনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি, সেই দিনই মাস্ক কিনলাম।

মাথার মধ্যে অনেক ধরনের চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভালো, খারাপ উভয় ধরনের চিন্তাই করছিলাম।

করোনা এ দেশে কত দিন স্থায়ী হবে? কত ক্ষতি হবে এর ফলে? কত মানুষ আক্রান্ত হবেন? কত মানুষ মারা যাবেন? কত প্রিয়জন হারাব আমরা? আমার অনেক বন্ধুও কি মারা যাবে? আমিও কি মারা যাব?

আবার এই ভাইরাস একদিন শেষ হয়ে যাবে, পৃথিবী আবার তার আগের রূপ ফিরে পাবে—এসব কথাও ভাবছিলাম।

এসব চিন্তা করছিলাম ওই ৮ মার্চের বিকেলে।

আজ আড়াই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে প্রথম করোনা শনাক্তের দিন থেকে। এখনো প্রতিদিন আড়াইটায় সংবাদ সম্মেলন দেখা হয়, দেখা হয় মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কত মানুষ। হয়তো কারও বাবা, কারও মা, কারও সন্তান, কারও বন্ধু, কারও প্রিয়জন। আমি শুধু এটাই ভেবে যাচ্ছি, যা শুরু হয়েছিল ওই ৮ মার্চের বিকেলে, তার শেষ কোথায়? আর শেষটা কি আমি দেখতে পারব?

*শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। [email protected]