লকডাউনের জীবনযাত্রা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আজ তৃতীয় দফার মতো আম্মু গৃহকর্মীকে কাজে আসতে মানা করে দিলেন। মাস্ক পড়ে কাজ করতে রাজি না, তার নাকি দম বন্ধ লাগে। তাই আম্মুর এ সিদ্ধান্ত। আম্মুর আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট সমস্যা রয়েছে, তাই বাড়তি সর্তকতা। আবার সেই ঘরের কাজগুলো নিজেদের করতে হবে। 'আল্লাহ না করুক, আমাদের মধ্যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে যে কষ্ট করতে হবে, তার চেয়ে ঘরের কাজ করার কষ্ট তো কম', আম্মুর যুক্তি।

আম্মু দেশের একটি বেসরকারি কোম্পানির যুগ্ম সাধারণ নির্বাহী। ২৬ মার্চ হতে সাধারণ ছুটির ফলে এতোদিন বাসায় বসেই অফিসের কাজ করছেন। বেলা ১১টার দিকে ল্যাপটপ নিয়ে বসেন, কাজ শেষ হতে হতে বিকেল তিনটা-চারটা বেজে যায়। কখনো দেখি ম্যানেজারদের বা বসের সঙ্গে জুম মিটিং করছেন, কখনো বা অফিসের কাজে ফোন কনফারেন্সে ব্যস্ত আম্মু। কোনো কোনো দিন একজন অফিসার আমাদের বাসার নিচে এসে কিছু অফিসের কাগজপত্র দিয়ে যান, আমি নিচে এসে সেগুলো নিয়ে আম্মুকে দেই। আম্মু সেগুলো চেক করে আবার আমাকে বলেন সেগুলো অফিসারের হতে দিয়ে দিতে। এভাবেই চলছে তার অফিসের কাজ। আব্বুর শেয়ার ব্যবসাও পুরোপুরি থমকে আছে করোনার জন্য।

রোজার মাসে কোম্পানি তার কর্মীদের বোনাস দেয়। এবার বোনাসের ২৫% দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তা- কর্মচারীদের। তবুও, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের অবস্থা ভালো। যেখানে দেশের অনেক মানুষ বেতন পাচ্ছে না ঠিকমতো, কাজের অভাবে খাবার পাচ্ছে না, সেখানে বোনাসের কথাটি টেনে আনা যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে আম্মুর মনে শঙ্কা থেকেই যায়। গত মাসে একদিনও অফিসে সশরীরে উপস্থিত না হয়ে পুরো মাসের বেতনই দিয়েছে কোম্পানি। দেশের অবস্থা যেভাবে অবনতি হচ্ছে, তাতে লকডাউন আরো বাড়তে পারে। পরবর্তীতে কোম্পানি কর্মীদের প্রতি কিরূপ ব্যবস্থা নেবে, আম্মুর মনে সেই প্রশ্ন।

আব্বুকে দেখি, ফেসবুকে কোন এক নাম না জানা নিউজ পোর্টালে করোনার ভ্যাকসিনের সফলতা দেখে উল্লসিত হতে। পরবর্তীতেই দেখি তিনি নিরাশ, 'করোনার ভ্যাকসিন কি কখনও আবিষ্কার হবে না?' শিরোনামে বিবিসির নিউজ দেখে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, যেন আমাদের এই দুঃসময় কেটে যায়।

এই করোনা কাল আমার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে। এখন বেলা করে ঘুম থেকে উঠা আমার স্বভাব। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, তাই পড়াশোনাও নেই। দিনের অধিকাংশ সময় কাটে গেম খেলে, ফেসবুক-মেসেঞ্জার-ব্রাউজিং করে। বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়। সরকার যদিও মসজিদ খুলে দিয়েছে, আব্বু ও আমি মসজিদে যাচ্ছি না, জুম্মার নামাজের জন্যও না।

প্রতিদিন বেলা আড়াইটায় একরাশ হতাশা নিয়ে টিভির সামনে বসি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং দেখতে। দেখি আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কেবল বাড়ছে। এই ব্রিফিং আমার জন্য যেমন একটা শঙ্কার ব্যাপার, দেশের অসচেতন মানুষের কাছে এই পরিসংখ্যান কেবলই সংখ্যা। পত্রিকায় যখন দেখি, মাওয়া ঘাটে মানুষ গিজগিজ করছে, ফেরি ভর্তি মানুষ, তিল ধারণের ঠাঁই নেই, মনের আনন্দে মানুষ শপিং করছে, মনটা খুব বিষিয়ে উঠে। জীবনের মূল্যের চেয়ে যেন ঈদ করার আনন্দটাই বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনলাইন ক্লাস নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কিছুই যেন আর ভালো লাগছে না, কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। মাঝে মাঝে ছাদে যাই। চারতলা বাসা, নিচু ছাদ। আশেপাশে বিল্ডিং পরিবেষ্টিত বিধায় তেমন কিছুই দেখা যায় না। তবুও ছাদে ফুলগাছের ফুল গুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। আকাশ দেখি, আকাশ দেখতে ভালো লাগে। রাতের বেলা ছাদে গিয়ে আকাশের তারা দেখি।

'রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে', ছোটবেলায় পড়েছিলাম। করোনার এই দুঃসময় এক অমাবস্যার রাতের মতো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিন্তু তাই বলে কি ভয়ে কাঁপতে থাকব? সকাল হবেই, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে সূর্যের রশ্মি। একদিন এই দুঃসময়ের অবসান ঘটবে ইনশা আল্লাহ। অন্ধকার দুর হবে প্রভাতের সূর্যের মাধ্যমে। শিগগিরই যেন সেই সূর্যের আলো গায়ে লাগিয়ে আমরা সবাই উল্লাস করতে পারি, আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই থাকলো।

*প্রথম বর্ষ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]