লকডাউনে আমার দিনকাল

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

বর্তমানে কোভিড-১৯ এর কারণে আমরা সবাই গৃহবন্দী। আমি দুই মাসের বেশি হতে চলল, ঘর থেকে বের হইনি। সেটা আমার জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ, লকডাউনের আগ পর্যন্ত আমি বেশির ভাগ সময় বাসায় থাকতাম না। যেহেতু আমি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাই প্রায় প্রতিদিনই আমার নাচের ও নাটকের মহড়া থাকত। এ ছাড়া স্কুল ও স্যারের বাসা তো রয়েছেই। বলতে গেলে আমি সারা দিন মানুষের মধ্যে এবং ঘরের বাইরে থাকতাম।

এখন আমি ঘরে বাবা-মাসহ একাই থাকি। সারা দিন খুব একা লাগে এবং সারাক্ষণ মনে হয় কখন আমার নাচের মহড়া শুরু হবে এবং কবে আমি আমার থিয়েটারের সবার সঙ্গে দেখা করতে পারব। তবে আমি আমার একাকিত্ব কাটাতে প্রচুর বই পড়ছি এখন।

আগে ব্যস্ততার কারণে বই ততটা ধরতে পারিনি, পড়া তো দূরের কথা! এখন এই লকডাউনের কারণে আমি অনেক বই পড়তে পারছি। ইতিমধ্যে আমি পড়ে শেষ করেছি ‘আনা ফ্রাংকের ডায়েরি’, ‘শাহ আবদুল করিমের জীবন ও গান’, ‘মুক্তিযুদ্ধে কিশোর গল্প’, আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাস এবং ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’। বই পড়লে আমার মনে একধরনের প্রশান্তি জেগে ওঠে, সেই সঙ্গে সময়টাও ভালো কাটে। বই পড়া আমার বরাবরের অভ্যাস। আমার বিছানার বালিশের কাছে ৪–৫টা বই থাকবেই। মা প্রতিদিন সেগুলো বইয়ের তাকে গুছিয়ে রাখেন, আমি আবার খুঁজে খুঁজে ৪ থেকে ৫টা বই নিয়ে এসে বালিশের কাছে রাখি। রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়ে তবেই ঘুমাই।

এই লকডাউন জীবনে আমি প্রথমবার নাচ কম্পোজিশন করেছি। সে নাচটি বিশ্ব নৃত্য দিবসে আমার গুরুদের উৎসর্গ করেছি। নাচ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি, নাচটা যখন মনে মনে তৈরি করি, তখন মনোযোগটা একাকিত্বের দিকে থাকে না, মনে হয় আমি স্টেজ পারফরম্যান্সের জন্য মহড়া করছি। তখন কিন্তু বেশ ভালোই লাগে। আর আমি সেই সঙ্গে একাধিক লাইভ প্রোগ্রামও করছি। শিশু-কিশোরদের সংগঠন ‘পাঠশালা’ আয়োজিত গৃহবাসী শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠান ‘পাখি সব করে রব’-এ আমি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি লাইভ করেছি। এখানে আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে লাইভে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করার পাশাপাশি সবার সঙ্গে কথা বলতে পারছি, আগের মতো গল্প করতে পারছি। তবে সরাসরি, সশরীরে গল্প করার বিকল্প তো আর ইন্টারনেট হতে পারে না! তবু আমাদের কিছু তো একটা আছে, যাতে আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছি, সেটা ভিডিও কলই হোক বা লাইভ হোক। তবে যাদের আমাদের মতো ডিভাইস নেই, তারা যাতে তাদের সময় কাটাতে পারে, তাই আমরা পাঠশালার পক্ষ থেকে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি রংতুলি খাতা। আশা করি, তারা ইচ্ছামতো ছবি এঁকে তাদের সময়টা ভালোভাবেই কাটাচ্ছে।

আমি আরেকটা মজার কাজ করছি। প্রতিদিন বাসার ব্যালকনিতে পাখিদের খাবার দিই। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার প্রথম কাজ হলো পাখিদের খাবার দেওয়া। অনেক রকমের পাখি আসে যেমন শালিক, চড়ুই, দোয়েল। যদি কোনো দিন খাবার দিতে দেরি হয়, তবে এরা সবাই আমার বাসার বারান্দার রেলিংয়ের ওপর লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে চেঁচামেচি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে আমাকে বিছানা থেকে উঠে খাবার দিতে হয়। তবে আমার বেশ মজাই লাগে, কারণ, এটা ভেবে যে আমার অনেক বড় একদল ভক্ত রয়েছেন। যেহেতু আমাদের স্কুল বন্ধ, তাই আমাদের ক্লাসগুলো হয় অনলাইনে এবং সংসদ টিভিতে। ফলে মনে হয় স্কুলে বসেই শিক্ষকের সামনে ক্লাস করছি। তখন আমার খুবই ভালো লাগে এবং অনেক আনন্দ হয়। এ ছাড়া আমি এখন টুকটাক ঘরের কাজ করছি, মাকে সাহায্য করছি। এমনিতেই আমি খুবই অলস প্রকৃতির। কিন্তু এখন ঘরের কাজ করলে সময়টা ভালোই কেটে যায় বলে কাজ করি। এ ছাড়া আমি আমার মায়ের কাছে আবৃত্তির তালিম নিই। বর্তমানে আমি ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ও দোহারের শিল্পী অকালপ্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য রচিত এবং ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের গাওয়া গান ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’-এর সঙ্গে নাচ তুলছি। শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারকে আমি ‘মাকো’ বলে ডাকি। কারণ, তিনি আমার মামা ও কাকু—দুটোই।

কোভিড-১৯ এর কারণে আমি গৃহবন্দী আছি সেটা ঠিক, তবে ততটা খারাপ লাগছে না। তবে আশা করছি, আমাদের পৃথিবী আবার সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। নিশ্চয়ই আমি আবার নাচের মহড়ায় যেতে পারব, মঞ্চে আবার নাটক করতে পারব, স্কুলে যেতে পারব, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে পারব। আমাদের পৃথিবী নিশ্চয়ই আমাদের হয়ে উঠবে। আবার রঙিন হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই আমাদের পৃথিবী আমাদের রঙে।

* নবম শ্রেণি, বিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, সিলেট।