করোনার ঝুঁকি লঞ্চেই যাচ্ছে ঢাকা-বরিশাল

সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই নেই লঞ্চে। মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। এতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। গতকাল ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা লঞ্চঘাটে।  ছবি: প্রথম আলো
সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই নেই লঞ্চে। মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। এতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। গতকাল ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা লঞ্চঘাটে। ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় গতকাল পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৬২। গত সপ্তাহ পর্যন্ত সেখানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে চলতি সপ্তাহের হিসাবটা ভয় ধরিয়েছে অনেকের মনে। সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার ৫৫ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ঈদের আগে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের মতো করোনায় আক্রান্ত এলাকা থেকে মানুষ হুড়োহুড়ি করে বরিশালে ফিরে নিজ নিজ এলাকায় রোগটি ছড়িয়েছেন। আবার তাঁরাই গাদাগাদি করে লঞ্চে ফিরে আবারও রোগটির বিস্তারে ভূমিকা রাখছেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে সরকার গত ২৬ মার্চ নৌ ও সড়কপথে লঞ্চ ও বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। দুই মাসের বেশি তা বন্ধ থাকলেও বিকল্প নানা পথে ঈদে অসংখ্য লোক গ্রামে ফেরেন। তাঁরা বেশির ভাগ করোনার হটস্পট হিসেবে খ্যাত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুর এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী।

বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র জানায়, স্বাভাবিক সময়ে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে বিশেষ সার্ভিস শুরু হয়। এসব লঞ্চে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ লাখ লোক ঢাকা থেকে গ্রামে আসেন। সব মিলিয়ে বিভাগে ঈদের সময় ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক গ্রামে ফেরেন। আবার ঈদের পর ঢাকায় ফিরে যান। কিন্তু এবার লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় প্রতিবারের মতো এতসংখ্যক লোক গ্রামে ফিরতে না পারলেও বিকল্প পথে ৭ থেকে ১০ লাখ লোক গ্রামে ফিরেছেন বলে ধারণা।

গত রোববার শর্ত সাপেক্ষে নৌ চলাচল শুরুর পর এসব মানুষ ফিরতে শুরু করেছেন। গত তিন দিনে বরিশাল বিভাগের ৯টি স্টেশন থেকে প্রায় ৪০ হাজার যাত্রী ঢাকায় ফিরেছেন। এর মধ্যে বরিশাল থেকে প্রথম দিন গত রোববার তিনটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সুন্দরবন-১১, সুরভী-৯ ও অ্যাডভেঞ্চার-৯। এসব লঞ্চের ধারণক্ষমতা ১ হাজার ২০০ থেকে ৩০০ জন। কিন্তু প্রতিটি লঞ্চে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী ছিল। লঞ্চগুলোর ডেকে সাদা রং দিয়ে বৃত্ত এঁকে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু লঞ্চ ছাড়ার সময় হতেই ভেস্তে গেল সব। বৃত্ত আর সামাজিক দূরত্বকে ‘দূরে’ ঠেলেই গাদাগাদি করে লঞ্চে ওঠেন যাত্রীরা।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ঈদের আগে গ্রামে ফিরে আসা মানুষ স্বাস্থ্যবিধি তেমন মানেননি। তাঁরা পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আগের মতোই মিশেছেন। তাতেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই এ অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ঈদের পর অনেক বেড়েছে। বলতে গেলে আগে যেখানে প্রতিদিন ১০-৩০ জন আক্রান্ত হতো, ঈদের পর তা ৪০ থেকে ৫৫-তে পৌঁছেছে। এটা আমাদের জন্য একটা খুব উদ্বেগের বিষয়। পরিস্থিতি এখন এমন, আমরা খুব দ্রুত বড় ধরনের বিপদের দিকে এগোচ্ছি।’

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ৯ এপ্রিল বরিশাল বিভাগের দুই করোনা রোগীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিভাগে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তাঁদের একজন নারায়ণগঞ্জের পোশাকশ্রমিক, অপরজন ঢাকা থেকে ফিরেছিলেন। এরপর ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ৬ থেকে ১৫-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯ এপ্রিল এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯। এরপর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণ কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও মে মাসের শুরুতে আবার বাড়তে থাকে। ১ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৮ থেকে ১৩ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০ মের পর তা অনেক বেড়ে যায়। গতকাল মঙ্গলবার তা ৫৫ জনে পৌঁছায়। তার আগের দিন সোমবার শনাক্ত হয় ৪৯ জন, রোববার এ সংখ্যা ছিল ৫৮। মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভাগে মোট কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬২ জনে। তাঁদের মধ্যে ৩১৬ জনই বরিশাল নগরের। বিভাগে করোনা শনাক্ত রোগী মারা গেছেন ১৪ জন। আর করোনা উপসর্গ নিয়ে বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে গত ২৮ মার্চ থেকে সোমবার পর্যন্ত ৪৩ জন মারা গেছেন।

রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন সংক্রমণ বেশি ঢাকায়, অন্যদিকে বরিশাল অঞ্চলে কম। লঞ্চ যোগাযোগ বেশি এই রুটে। দেখা যাচ্ছে, লঞ্চে গাদাগাদি হচ্ছে। দ্বিমুখী যাতায়াতের ফলে ঢাকা-বরিশাল দুই দিকেই সংক্রমণ আরও বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। লঞ্চের ডেকে যাত্রীর জন্য জায়গা চিহ্নিত করে সেটা মানা হচ্ছে কি না, তদারকি করতে হবে। মালিক-শ্রমিক ও স্বেচ্ছাসেবীরা মিলে এটা করতে পারেন। প্রতিবার যাত্রা শেষে লঞ্চ বা পরিবহন মোছা উচিত। টার্মিনালগুলোতে লোকসমাগম কীভাবে কম রাখা যায়, সেটা ভাবতে হবে। লঞ্চ ও অন্যান্য গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। তাতে গাদাগাদি কম হবে।