>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
গাড়ির কাচ নামিয়ে মুখটা কিঞ্চিৎ বের করে আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা ভাই, গোবরের মাটি পাওয়া যাবে কোথায়?’
লোকটি ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দাঁড়িয়ে গেলেন। ট্রলি ঘাস–লতাপাতা দিয়ে ঠাসা। পাশের কোনো বাগান থেকে সংগ্রহ করেছেন হয়তো। বোধ করি এখানেই কোনো আরবের বাগান দেখাশোনা করেন।
ঘড়িতে ঠিক বেলা ১টা ৪৮ মিনিট। করোনায় সব লকডাউন। তখনো রমজান। এই সময়টায় মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে।
কোনো উত্তর না দিয়ে লোকটি ইঙ্গিতে জানতে চাইলেন, তাঁর সঙ্গেই কথা বলছি কি না। চকিতে ভাবলাম, তিনি হয়তো বাংলাদেশি নন।
বললাম, ‘ভাই কি বাংলাদেশি?’
‘জি, বাংলাদেশি।’ তাঁর কণ্ঠে বিনয়।
আমার আলাপ শেষ। বিরক্ত লাগছে। লকডাউনে জীবন ওষ্ঠাগত। বাগানবিলাস নিয়ে কালক্ষেপণের কী আছে?
ক্লিনিকে এসেছিলাম। ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়েছেন। রিপোর্ট পেতে ৩০–৪০ মিনিট দেরি হবে, তাই বাসায় না গিয়ে আশপাশে চক্কর দিচ্ছি।
ঘোরাঘুরির জন্য জায়গাটা মন্দ নয়। বেশ সবুজ। সবুজের উৎস পেছন দিকের বড় বড় কিছু পাহাড়। পাহাড় থেকে ঠিক ঝরনা নয়, ভেতর থেকে চুইয়ে পানির একটা অন্তঃশীল প্রস্রবণ আসে। সে পানি অভিন্ন স্রোতে নিয়ে এসে নালায় করে নিচের গ্রামগুলোতে প্রবাহিত করা হয়। সে পানি কৃষিকাজে, বিশেষ করে খেজুরবাগানে লাগে।
আমার স্ত্রী আবার প্রশ্নটা করে, ‘গোবরের মাটি কি কোথাও পাওয়া যাবে?’
স্মিত হেসে লোকটির পাল্টা প্রশ্ন, ‘গোবরের মাটি দিয়ে আপনারা কী করবেন?’
ফুলগাছ লাগাব। আমার স্ত্রীর উত্তর।
লোকটি এবার বললেন কোথায় তা পাওয়া যেতে পারে। আমার স্ত্রী একটু বিমর্ষ। বুঝতে পেরেছে, এখন কেনার সুযোগ হবে না।
লোকটি সম্ভবত আন্দাজ করেছেন। বললেন, ‘কাল আসুন। আমি এনে রাখব।’
আমার স্ত্রীর মুখের বিমর্ষ ভাব বিশেষ কাটল না।
তাই দেখে লোকটি বললেন, ‘গাড়িটা ওই গাছের ছায়ায় রাখুন তো। দেখি, কিছু করা যায় কি না।’
আমার স্ত্রীর মেঘলা ভাব একটু দূর হলো। ফ্যাকাসে ফুলপ্যান্ট আর মলিন টি-শার্ট পরা চল্লিশোর্ধ্ব লোকটি ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে একটা গেট দিয়ে ঢুকে গেলেন।
গাছের ছায়ায় গাড়ি রেখে আমরা তার ভেতরে বসেছি। করোনার ভয়ে আশপাশে জনমনিষ্যি নেই। খারাপ লাগছে না। বাসা থেকে বেরিয়েছি বহুদিন পর।
বড় একটা কার্টন নিয়ে লোকটি বের হয়ে এলেন। আমি গাড়ির পেছন দিকটা খুলে দিলাম। কার্টনটা তার ভেতরে রেখে তিনি বললেন, ‘দাঁড়ান, গোবরের বস্তাটা নিয়ে আসছি।’
মানে? আমি ভাবলাম, তাহলে কার্টনে কী?
‘না, নিজের বাগান থেকে সংগ্রহ করা কলা, খেজুর আর খেজুরের হালুয়া।’
দরজা খুলে নামতে চাইলাম। কিন্তু দেওয়াল ঘেঁষে গাড়ি রাখায় দরজা খুলতে পারলাম না। লোকটা মাটির বস্তা গাড়ির ডালায় ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, এবার যান।
আমি কাছে ডেকে মানিব্যাগ বের করলাম। কিন্তু তিনি মোটেই নেবেন না।
আমি বললাম, ‘আপনি যা দিয়েছেন, তার তো দাম হয় না। আপনি আমাকে চেনেন না, দিয়েছেন আমি শুধু বাংলাদেশি বলে। দেশের প্রতি এই দরদের তো কোনো মূল্য হয় না। এটা দিয়ে আপনি ইফতার করবেন।’ বেশ জোর করে টাকাটা হাতে গুঁজে দিলাম।
গাড়ি চলতে শুরু করল। লোকটি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমার সাত বছর বয়সী ছেলের ততক্ষণে অনেক প্রশ্ন: আচ্ছা, উনার বাচ্চারা কোথায়? বাচ্চাদের আম্মা কোথায়? উনারা কি এই ঘরেই থাকেন?
আমার মুখে কোনো জবাব নেই। মনটা কেমন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে।
গাড়ির আয়নায় দেখি, এখনো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশের মায়া লেগে আছে তাঁর অবয়বে।