দিন রাতের ব্যাপারটাই নিয়ম মেনে হচ্ছে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

লেখাটা যখন লিখছি, তখন মধ্যরাত। প্রায় রাত দুটো বাজতে চলেছে। চোখে এক ফোঁটা ঘুমও নেই। সারা রাত প্রায় জেগেই থাকা হয়। উঠি বেলা করে। কোনো কিছুই এখন আর নিয়ম করে হচ্ছে না। কীভাবে যেদিন গিয়ে রাত হয়, কেউ খোঁজ রাখে না। এই দিবারাত্রির ব্যাপারটাই একমাত্র নিয়ম মেনে হচ্ছে। বাকি সবকিছুই হয়ে গেছে এলোমেলো, হ য ব র ল।

কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে একটু ছুটির জন্য চাতক পাখির মতো প্রতীক্ষায় থাকতাম। ব্যস্ত সময়ের ছুটির সেসব দিন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যেত। রাত ফুরোলেই আবার সেই বয়ে চলা চিরচেনা জীবন। দম ফেলার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রকৃতি দম ফেলার সুযোগ করে দিল। কিন্তু এই সুযোগটা এমন যে দমবন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে! একটা অজানা আতঙ্ক সবাইকে গ্রাস করে রেখেছে। এমন অখণ্ড অবসর তো কেউ কখনোই চায়নি!

আমি ঢাকায় থাকি। পড়াশোনা করি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাস, ল্যাব, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট লেগেই থাকে। ছাত্রজীবনের স্বাভাবিক ব্যস্ততা যাকে বলে আরকি। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস আর ল্যাব করে যখন ক্লান্ত হয়ে হলে ফিরতাম, বাসার জন্য মনটা ভীষণ খারাপ হতো। বাবা, মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করত। বোনের সঙ্গে দুষ্টুমিগুলোকেও খুব মিস করতাম। বাসায় ভিডিও কলে কথা বলতাম। মায়ের একটাই কথা, ‘কবে আসবি বাবা?’

আমি বলতাম, ‘আসব মা। একটু বড় ছুটি পেলেই চলে আসব।’

বড় ছুটি মানে ঈদ, পুজোর ছুটি। বাসা দূরে হওয়ার কারণে দু–চার দিনের ছুটিতে তেমন আসা হতো না। মা আমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে আর ক্যালেন্ডারে দিন গোনে। আমিও ওদিকে পড়াশোনার চাপে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি। অনেক কিছুই ভুলে থাকি। ভুলে যাওয়া জিনিসগুলো রাতে ঘুমানোর সময় বড্ড জ্বালাতন করে। মনে মনে ভাবি, ‘ইশ, আমার বিশ্ববিদ্যালয়টা যদি বাসার খুব কাছাকাছি হতো! তাহলে বাবা, মা, বোনকে সারাক্ষণ পাশে পেতাম।’ বুক বেয়ে দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে। অশান্ত মন নিয়ে আরও ভাবি, ‘পরিবারের সাথে কেমন একটা দূরত্ব হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। দূরে থাকি বলে আমার শরীর খারাপ হলে মাকে বলি না, তারা টেনশন করবে বলে। আমিও বাসার খুঁটিনাটি সবকিছু জানতে পারি না। যদি আবার আমি টেনশন করি!’ এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, নিজেও জানি না। সকালে উঠে আবার দৌড়াই ক্লাস করার জন্য।

চারপাশে এত মানুষ! এত কোলাহল! বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেতে থাকি। সবকিছু মিলিয়ে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল জীবনটা। এমনিতে অবসরে গল্প–উপন্যাসের বই পড়তে ভালো লাগে। লাইব্রেরিতে যাই, বই কিনি। যে টেবিলে পড়াশোনা করি, তার একটা ভাগ শুধু এসব বই রাখার জন্যই। বই কেনা একধরনের নেশার মতো। বই জমাতে ভালো লাগে। বড় ছুটিতে বাসায় এলে আমি বইগুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসি। ছুটিটা বেশ ভালোই কাটে। এবারের বইমেলায় একটা গল্পগ্রন্থে আমার লেখা ছোটগল্প ছাপা হয়েছিল। সেই জন্য আমি দুদিনের ছুটিতে বাসায় এসেছিলাম বইমেলায় যাওয়ার জন্য। বইমেলা ঘুরে যখন ফেরার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছি, মা বলল, ‘এত কম সময় নিয়ে এলি, আবার কবে আসবি বাবা?’

আমি বললাম, ‘মা, সামনে তো রোজা। একেবারে ঈদের ছুটিতে আসব।’

মা যথারীতি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

সিলেট ফিরেই সেই ব্যস্ত জীবন শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তখনই আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিল। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমি এত দিন যেসব বই কিনে জমিয়েছিলাম, সব নিয়ে আসলাম বাসায়। সত্যি বলতে কি, আকস্মিক এমন লম্বা একটা ছুটি পেয়ে খানিকটা যেন খুশিই হয়েছিলাম। ‘হাপ ছেড়ে বাঁচব, মা তার ছেলেকে অনেক দিন কাছে পাবে, নিজের হাতে রান্না করা খাবার খাওয়াবে, আমিও পরিবারকে কাছে পাব’, এমনটাই ভেবেছিলাম।

কিন্তু?

এভাবে কত দিন?

এক সপ্তাহ? দুই সপ্তাহ? তিন সপ্তাহ?

এদিকে এক মাস পেরিয়ে দুই মাস হতে চলল। গৃহবন্দী হয়ে আছি। কোথাও বের হচ্ছি না। খুব জরুরি প্রয়োজনে বাইরে গেলে রীতিমতো ভয় পেয়ে যাচ্ছি। কোথাও কেউ নেই৷ আশপাশ নজর করে দেখলেই মনে হয়, শহরটার যেন বড্ড অসুখ!

হঠাৎ একটা দুটো রিকশা চোখে পড়ে। বেল বাজার টুংটাং শব্দে গায়ে কাঁপুনি ধরে যায়। নিস্তব্ধ নীরবতা আচমকা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। মানুষ মানুষের থেকে এভাবে দূরে সরে যাবে, যেতে হবে, এমন দিনও যে আসতে পারে, তা কে ভেবেছিল?

প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণের হার। মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। গরিব, দুঃখী, অসহায় মানুষেরা ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। যতটা না করোনার ভয়, তার চেয়ে বেশি ভয় ক্ষুধার।

যেসব বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম, সেসব পড়া হয়ে গেছে। কী করা যায় ভাবছিলাম। দেখলাম উঁচু উঁচু দালানের ছাদে শিশুরা একখণ্ড আকাশ খুঁজে পেয়েছে। তারা মনের খুশিতে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আকাশ মোটামুটি ঢেকে গেছে রংবেরঙের ঘুড়িতে। মনে হয় যেন ঘুড়ি উৎসব!

ক্রমাগত বিষবাষ্প গ্রহণ করতে করতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ভাবলাম ঘুড়ি ওড়াই। ঘুড়ি ওড়ানোর আবার কোনো বয়স আছে নাকি? ফেলে আসা শৈশবে ফিরে গেলাম কিছু মুহূর্তের জন্য।

বারান্দায় ফুলের বাগান করেছি। গোলাপ, বেলি ফুলের গাছ লাগিয়েছি। মা লাগিয়েছেন মরিচ, বেগুন আর কিছু শাকসবজির গাছ। নিয়মিত যত্ন নিই। অপেক্ষা করি কবে গাছে ফুল আসবে, কবে সেই ফুল সুবাস ছড়াবে...

মাঝেমধ্যে লেখালেখি করি। আগামী বইমেলার জন্য লেখালেখিটা গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছি। জানালা দিয়ে আকাশের ছবি তুলি। সিনেমা দেখি। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখতে খুব ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে, ইশ, একটা সিনেমা যদি বানাতে পারতাম! একটা সুন্দর, দারিদ্র্যহীন বাংলাদেশের সিনেমা...

এই কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে পরিবারের সঙ্গে পুরোটা সময় কাটালাম। কত দিন এভাবে একসঙ্গে বসে গল্প করা হয়নি! মায়ের কাছে কত শত গল্প শোনা হয়নি!

জীবিকার তাগিদে বাবা অফিসে যান। সারা দিন খুব টেনশন হয়। আতঙ্ক কাজ করে। বাবাদের কোনো ছুটি থাকে না। মহান আল্লাহ তাআলা সব বাবাকে সুস্থ রাখুন। এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।

লেখা শেষ করব। তার আগে একটা কথা বলি। কয়েক দিন আগে বিকেলে দেখলাম, আমার গোলাপগাছে একটা ফুল ফুটেছে। একটা কলিও এসেছে। অনেক দিনের অপেক্ষার পরে এই দৃশ্য দেখে এত ভালো লাগল! সুন্দর ঘ্রাণে মনটা ভরে গেল। ফুলটার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। মুচকি হেসে মনে মনে বললাম, তবু তো ফুল ফোটে, সুবাস ছড়ায়...

জানি না ফুলগুলো আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিল কি না। হঠাৎ কোথা থেকে বাতাস এসে ফুলগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে চলে গেল।

মনে হল ফুলগুলো দুলতে দুলতে আমাকে বলছে, ‘দেখবে, একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। রাতের গভীরতাই তো ভোরের আলো নিয়ে আসে। তাই না? কেন? কবিতায় পড়নি-মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে...।’

*শিক্ষার্থী, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
[email protected]