মানব পাচার চলছেই, মামলা ঝুলে থাকছে

থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে গণকবর পাওয়া গিয়েছিল ২০১৫ সালের ১ মে। তারপর মালয়েশিয়াতেও পাওয়া গেল। পাওয়া গেল নির্যাতন শিবির।

সেই বছর এ দুটি দেশ আর ইন্দোনেশিয়া থেকে মানব পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার ১৭৫ জনকে সরকার দেশে ফিরিয়ে আনে। তাঁরা বিমানবন্দর থানায় তিনটি মামলা করেন। থাইল্যান্ডে বিচারে পাচারকারী চক্রের সাজা হয়েছে। বাংলাদেশে বিচার এখনো ঝুলে আছে। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাত্র ৬ জন।

কয়েক বছর ধরে পাচারকারীরা ইউরোপে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষকে লিবিয়ায় নিচ্ছে। সেখানে তাঁরা অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে মারা যান। 

এসব ঘটনায় মামলা যদিও–বা হয়, তদন্ত আর বিচার এগোয় না। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি হওয়ার পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর ২০১৪ সাল থেকে এযাবৎ মাত্র ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তির হারই খুব কম।

গত ২৭ মে লিবিয়ায় গুলিতে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জন বাংলাদেশিকে। ২ জুন র‌্যাব কামাল হোসেন ওরফে হাজি কামালকে (৫৫) গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাব বলছে, তিনি মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা। অভিজ্ঞজনেরা যদিও বলছেন, মূল ব্যক্তিরা সচরাচর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, জনশক্তি রপ্তানিকারক, আইনজীবী মিলিয়ে অন্তত ১১ জন অভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, মানব পাচার মামলায় মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের দালালেরা গ্রেপ্তার হন, সচরাচর যাঁরা ভুক্তভোগীর পরিচিত বা প্রতিবেশী। তদন্তে ঘাটতি থাকায় অনেক আসামি খালাস পান।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করে। সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচার চক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা তথ্য দেন না।

তবে অভিবাসন নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, আইনের শাসন থাকলে এত মানুষ পাচারের শিকার হতো না। পাচারকারীরা অনেককেই টাকার ভাগ দেন। এটা বন্ধ করতে হলে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে।

লিবিয়া হয়ে পাচার
পাচারকারীদের খপ্পর থেকে দেশে ফেরা তিনজন এ প্রতিবেদককে বলেছেন, বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত চক্রের জাল বিছানো। পাচারকারীরা দফায় দফায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন। দেশ থেকে হুন্ডি করে টাকা আনাতে হয়। লিবিয়ায় প্রায়ই কোনো দল অপহরণ করে নিয়ে যায়। মুক্তিপণ দিতে হয়।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি বলছে, অনেক সময় অভিবাসনের নামে পাচার চলে। ইউরোপে অভিবাসনের হাতছানিতে গত বছরও ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন এবং উদ্ধার হয়েছেন অনেক বাংলাদেশি।

লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ২০১১ সালে ৩৭ হাজার বাংলাদেশিকে ফেরত আনা হয়েছিল। তারপর দেশটি পাচারের পথ হয়ে ওঠে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে গড়ে ওঠা দালাল চক্র এলাকার লোককে এই পথে পাচারের ব্যবসায় যুক্ত। 

অবশ্য বেসরকারি খাতে বিদেশে কর্মী পাঠানো এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো পাচারে জড়িত নয়। পাচারকারীদের শাস্তি হচ্ছে না।

মামলার ঝুলে থাকা
মানব পাচারের বড় এলাকা কক্সবাজার। জেলাটিতে এযাবৎ মানব পাচারের ৬৩৭টি মামলা হয়েছে। ১টিরও নিষ্পত্তি হয়নি। প্রায় অর্ধেক তদন্তাধীন। খারিজ হয়ে গেছে ১৬টি মামলা। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, আইনটি হওয়ার পর গত প্রায় আট বছরে দেশে ৫ হাজার ৭১৬টি মামলা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৪৭টি অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিচারাধীন আছে প্রায় ৪ হাজার ৪০৭টি মামলা। 

আইনে বিচারের জন্য আলাদা করে বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান ছিল। ৮ বছর পর সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আদেশ হয়েছে। বিচার এখনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই হচ্ছে। মামলা ঝুলে যাওয়ার সেটা একটা কারণ।

আরেক বড় কারণ আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পুলিশের ব্যর্থতা। ঢাকা মহানগরে সরকারের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচার মামলায় সাক্ষী নিয়মিত পাওয়া যায় না। 

ক্যান্টনমেন্ট থানার ২০০২ সালের একটি মামলায় সাক্ষী হাজির করার তারিখ পড়েছিল ৫৬ বার। তেজগাঁও থানায় ২০০৫ সালের একটি মামলায় পড়েছিল ৪৮ বার। এ প্রতিবেদক ১৭টি মামলায় বারবার তারিখ পড়ার তথ্য পেয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর ছিদ্দীক প্রথম আলোকে বলেন, এক মামলায় ১১৮ বার তারিখ পড়ার পরও সাক্ষী পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আইনে সুযোগ না থাকলেও অনেক সময় দুই পক্ষ আপস করে ফেলে। তখন মামলা চালানো কঠিন। 

মেহেরপুরের মাসুদ রানা প্রতারিত হয়ে নেপালে পাচার হয়েছিলেন। ২০১১ সালে ফিরে এসে মামলা করেন। সেই মামলা এখনো চলছে। মাসুদ বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে আছেন। অথচ এই আইনের মামলা জামিনযোগ্য নয়।

আইন বলছে, ৯০ দিনের মধ্যে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দেবে এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। তেমন নজির প্রায় নেই। ২০১৩ সালে সিরাজগঞ্জের রমজান আর ঢাকার কাকরাইলের নাসির খানের মাধ্যমে দিনাজপুরের মোজাম্মেলসহ নয়জন ইরাকে যান। কাজ পাননি। ফিরে এসে তাঁরা মানব পাচার আইনে মামলা করেন। মোজাম্মেল প্রথম আলোকে বলেন, রমজান ও নাসির জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।

বিচার ও সাজা
২০১৪ সালের মাঝামাঝি ঢাকার সায়েদাবাদের বাসিন্দা শাহীনুর বেগমকে লেবাননে নেওয়ার কথা বলে দালালেরা সিরিয়ায় পাঠান। সেখানে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে আট মাস পর তিনি কোনোমতে দেশে ফেরেন।

শাহীনুরের মা খাদিজা বেগম এজাহার দিয়ে পল্টনের সিরাজ শিকদারসহ ১১ জনকে আসামি করে পল্টন থানায় মামলা করেন। ইতিমধ্যে মা মারা গেছেন। শাহীনুর বলেন, অভিযুক্তদের কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। মামলার অবস্থার কথা তিনি জানেন না, কেঁদে বললেন, ‘স্যার, বিচার কি পামু না?’ 

পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্রের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, সাজার হার একেবারেই নগণ্য। আইনটিতে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাবাস। সঙ্গে মোটা অর্থদণ্ড আছে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, ভুক্তভোগী সহায়তা না করলে এ ধরনের মামলা প্রমাণ করা খুব মুশকিল। তা ছাড়া প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শাস্তি চড়া হলে প্রমাণের ভার কঠিনতর হয়। শাস্তির দৃষ্টান্ত বাড়াতে হলে আইনের সংস্কার লাগবে।