ডেঙ্গু-করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

পেশায় আমি একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা। মূল কাজ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের সঙ্গে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রায় সব গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা আসেন। আমি কারও অপু, কারও অপু ভাই। এই সাংবাদিকেরা আমাকে কতটা ভালোবাসেন, তা বুঝলাম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর।

স্বাভাবিক সময়ে সাংবাদিকদের যত ফোন পেতাম, এখন পাই তার চেয়ে অনেক বেশি। খুব কষ্ট হয় এত ফোন ধরতে। কারণ, শুধু করোনা নয়, একই সঙ্গে আমি আক্রান্ত  হয়েছি ডেঙ্গুতে। আমার স্বজন-সুহৃদদের ভয় ছিল, একসঙ্গে দুটি যুদ্ধ আমার শরীর করতে পারবে কি না। এখন ডেঙ্গুমুক্ত হয়েছি। করোনামুক্ত হওয়ার যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে মনোবল জুগিয়েছেন সাংবাদিক, সুহৃদ ও সহকর্মীরা।

সাংবাদিকদের পাশাপাশি এলাকার মানুষের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। আমর বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং থানার পূর্ণমতি গ্রামে। রমজান মাসের শেষ জুমায়, মসজিদে ঈদের জামাতে আমার জন্য দোয়া করেছেন এলাকাবাসী। এই খবর জানার পর নতুন করে নিজেকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার স্বপ্ন দেখছি।

এলাকার জন্য বড় কিছু করতে পেরেছি, এমনটি নয়। কিন্তু যেটুকু করেছি আন্তরিকতার সঙ্গে, জন্মমাটির প্রতি ভালোবাসার তাগিদ থেকে। আমার দাদা হাজী ফজর আলীর নামে শিক্ষাবৃত্তি দিই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের। নানাজনের কাছ থেকে বেসরকারি সহায়তা নিয়ে দড়িয়ারপাড় কবরস্থান মেরামত করেছি, যেখানে দাফন করা যাবে হাজার তিনেক মানুষের মরদেহ।

করোনাকালে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে এলাকায় গিয়ে ত্রাণ ও ঈদ–উপহার দিয়েছি। আর এসব করতে গিয়ে কোনো এক ফাঁকে শরীরে ঢুকেছে ঘাতক ভাইরাসটি।

গত ১৮ মে রাতে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় আমার কাশি হচ্ছিল। রোজিনা আপা জানতে চান জ্বর আছে কি না। বললাম, মনে হচ্ছে। পরদিন প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। চিকিৎসকের পরামর্শে প্রথমে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাই। দেখা গেল, পজিটিভ। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাই, সেটিও পজিটিভ। শুরু হয় বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এরপর বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। ওষুধ, পথ্য, খাবার, স্বাস্থ্যবিধি—সবই মেনে চলার চেষ্টা করছি। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্যার আমার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর নিয়মিত খোঁজ নিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন—গভীর কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি।

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার মধ্যেই ঈদ পার হয়েছে। ঈদের সকালে ঘুম থেকে উঠেই নতুন অভিজ্ঞতা। আমার এক বছর বয়সী ছেলে তার মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার কক্ষের সামনে হামাগুড়ি দিয়ে হাজির। তার কোলে ওঠার আবদার। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। আমি কোথায় পালাব। সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। জোরে ওর মাকে ডাক দিই। সে দ্রুত এসে ছেলেকে সরিয়ে নিয়ে গেলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।

কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১৫ দিন দুই ছেলেকে বঞ্চিত করে চলেছি। তাদের মা ও চাচা সব সময় চোখে চোখে রাখে। আর তারাও সুযোগ খোঁজে তাঁদের ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে আসার। কেউ পাশে না থাকলেই আমার কক্ষের দিকে রওনা হয়। আমাকে তখন চিৎকার করে বলতে হয়, ওদের নিয়ে যাও। ঈদের সকালে শিশুসন্তানকে কোলে নিতে পারলাম না। বিষয়টি সামান্য, কিন্তু একজন বাবা হিসেবে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে। তার কান্নায় নিজেকে সামাল দিতে কষ্ট হয়। এরপর দিনভর মানুষের ফোন। যত কষ্ট হোক, সবার ফোন ধরার চেষ্টা করেছি। করোনার এই কঠিন সময়ে সবাই আমাকে অভয় দিয়েছেন, আমার জন্য দোয়া করেছেন—এটা আমার কাছে কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

ঈদের সকালে গোসল শেষে উপহার হিসেবে পাওয়া পাঞ্জাবি পরতে ভুলিনি। সুগন্ধি লাগিয়েছি। এরপর জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু পর হালকা রোদ এসে পড়ে শরীরে। মুহূর্তেই যেন ঈদের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। জানালা দিয়ে দেখতে পাই, একটু দূরে বাসার ছাদে একঝাঁক কবুতরের আনাগোনা। ওগুলোর দৌড়ঝাঁপ দেখি কিছুক্ষণ। হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমার ছোট ভাই, স্ত্রী ও সন্তান। চমকে উঠি। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলি। ছেলে দুটি আমাকে দেখছে। ছুঁয়ে দেখা দূরে থাক, কাছেও আসতে পারছে না।

বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল গত ৮ মার্চ। এর কিছুদিন পর ছুটি শুরু হয়। ছয়-সাতবার ছুটির মেয়াদ বেড়েছে। দুই মাসেরও বেশি সময় পর ৩১ মে খুলেছে সচিবালয়। খোলার প্রথম দিনেই অফিসে যেতে পারলাম না। সহকর্মী, সাংবাদিক ও সুহৃদ অনেকেই ফোন করেছেন, খোঁজ নিয়েছেন। অফিস খোলার খবর শুনে নিজের মধ্যে অস্থিরতা টের পাই। আমাকে যেতে হবে সচিবালয়ে। এই ঘর থেকে আমাকে বের হতেই হবে। মনে পড়ছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন: ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,/ কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’ আর ওই কবিতার শেষ লাইন: ‘বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’

আমার জন্য আপনারা দোয়া করবেন। আমি যেন সুস্থ হয়ে উঠতে পারি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বুঝতে পারি মানুষ আমাকে কতটা ভালোবাসে। সুস্থ হয়ে উঠলে এই ভালোবাসার প্রতিদান কর্মের মাধ্যমেই আমাকে দিতে হবে।