করোনাকালে দুধকুমারের দুই তীরের যাপিত জীবন

দুধকুমার নদের পাড়ে মেশিনে ধান মাড়াই করছে এক কৃষক পরিবার। দক্ষিণ তিলাই চর, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম, ২ জুন। ছবি: লেখক
দুধকুমার নদের পাড়ে মেশিনে ধান মাড়াই করছে এক কৃষক পরিবার। দক্ষিণ তিলাই চর, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম, ২ জুন। ছবি: লেখক

কিছুদিন আগে টানা সপ্তাহখানেকের বৃষ্টিতে দুধকুমার নদ ফুলেফেঁপে উঠেছে। খেয়াঘাটের নৌকা ভেড়ানোর স্থান হয়েছে বদল। নদের এপার-ওপারে বেশ কিছু নিচু জমির পাকা বোরো ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে অনেক কৃষকের হয়েছে সর্বনাশ। তবু জীবন থেমে থাকার নয়। স্রোতস্বিনী দুধকুমারের মতোই বয়ে চলেছে দুই তীরের মানুষের জীবন-জীবিকা।

শ্রম আর ঘাম যাঁদের প্রতিদিনের সঙ্গী, তাঁদের আবার করোনাকাল কী? ঘাটের নৌকার যাত্রী ও দুপারের মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের কোনো আলাপ নেই, আতঙ্কও নেই। তাই এখানে মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও শারীরিক দূরত্ব ঠিক রেখে চলার প্রসঙ্গ তোলাই যেন অবান্তর। হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁদের অব্যক্ত কথা এমন, ‘করোনা থাকে ওই বড় শহরে, এই অজপাড়াগাঁয়ে তাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’

যেসব এলাকার মানুষের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা ভারত সীমান্তঘেঁষা কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৩ নম্বর তিলাই ইউনিয়নের দুধকুমার নদপাড়ের বাসিন্দা। বাঘবাড়ি এলাকায় উজান দিকে ছুটে চলা ঘোলা জলে জাল ফেলেছে শাকিল। জালে পুঁটি-বৈরালি ধরা পড়ার আনন্দে আছে ষষ্ঠ শ্রেণির এই ছাত্র।

নদের পাড় ধরে সামনে এগোতেই খেতের পাটগাছের নড়াচড়া চোখে পড়ল। তটস্থ মন মনোযোগ দিল নড়াচড়ার দিকে। শৈশবে খেতে পাটগাছের নড়াচড়ার স্মৃতি তো বহুরূপী। বহুবিচিত্র স্মৃতি আছে অনেকের এই পাটখেতকে কেন্দ্র করে। এসব কথা মনে করে পাটগাছ নড়াচড়ার দিকে মনোযোগ আরও বেশি কেন্দ্রীভূত হলো। এবার দুটি মানুষের মাথা চোখে পড়ল। স্থানীয় ভাষায় আওয়াজ করে ‘ক্যারা’ (কারা) উচ্চারণ করা মাত্রই পাটখেতে দুজন দাঁড়িয়ে গেলেন। আশাদুল ইসলাম ও হৃদয় ইসলাম। তাঁরা বাপ-বেটা পাট টানার কাজ করছেন। তুলনামূলক ছোট পাটগাছ ও আগাছা তুলে পরিষ্কার করাকে পাট টানা বোঝায়। করোনার জন্য এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় খেতের কাজে বাবাকে সাহায্য করছেন হৃদয়। তাঁদের পাটখেতের পাশেই দক্ষিণ তিলাইয়ের খেয়াঘাট, যা শালমারা খেয়াঘাট হিসেবে পরিচিত।

দুধকুমার নদের পারের বিস্তীর্ণ পাটখেত। তিলাই ইউনিয়ন, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম, ২ জুন। ছবি: প্রথম আলো
দুধকুমার নদের পারের বিস্তীর্ণ পাটখেত। তিলাই ইউনিয়ন, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম, ২ জুন। ছবি: প্রথম আলো

মঙ্গলবার দুপুরে জ্যৈষ্ঠের খরতাপ থেকে বাঁচতে ঘাটের ছাউনির নিচে জড়ো হয়েছেন পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা। ১০ টাকায় প্রায় ২০ মিনিটের যাত্রায় ঘাট পার হওয়া গেল। ঘাট থেকে কাছেই গাছের ছায়ায় কয়েকটা খড়ের স্তূপে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন বেশ কয়েকজন যুবক। দুপুরের আলস্য আড্ডা ভেঙে যেতে মন সায় দেয় না। তবু যেতে হয়।

পলি ও বালুমিশ্রিত পথ পূর্ব দিকে আনন্দবাজার এবং নতুনবাজারের দিকে গেছে। আর পশ্চিম দিকে ঠেকেছে দুধকুমারে। ঘাট থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে দুধকুমারের পাড়ে ধান মাড়াই, ধান ওড়ানো, শুকানোর কাজে ব্যস্ততা লক্ষ করা যায় খোঁচাবাড়ির চরের মা, বোন, বধূ ও বাবাদের।

বৃদ্ধ আবদুল হামিদ (৬৫) তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক ছেলের বউকে নিয়ে মেশিনে ধান মাড়াই করছিলেন। তিন বিঘা জমিতে এবার ধান চাষ করেছেন তিনি। ধান চাষে যত খরচ বেড়েছে, এত সব খরচ করে পুষিয়ে ওঠা কঠিন বলে মনে করেন তিনি। তবু খাওয়ার জন্য ধান তো চাষ করতেই হয় তাঁকে। এক ফাঁকে তাঁর বড় ছেলে বেলাল হোসেনের (৩৫) সঙ্গে কথা হলো।

বিঘাপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা ধান কাটা, ঘোড়ার গাড়িতে করে ৮০০ টাকায় ধান বাড়িতে আনা ও ৫০০ টাকা ধান মাড়াই খরচের বর্ণনা দিয়ে হতাশ হলেন বেলাল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ভালো চাকরি না পাওয়ায় পরিবারের কৃষিকাজে মনোযোগ দিতে হয়েছে বেলালকে।

শ্যালো নৌকায় দুধকুমার নদ পারাপার। শালমারা ঘাট এলাকা, তিলাই ইউনিয়ন, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম, ২ জুন। ছবি: প্রথম আলো
শ্যালো নৌকায় দুধকুমার নদ পারাপার। শালমারা ঘাট এলাকা, তিলাই ইউনিয়ন, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম, ২ জুন। ছবি: প্রথম আলো

বেলালের বাড়ির উত্তর পাশে বটতলা চৌরাস্তার মোড়। এখানে বেশ কিছু দোকানপাট আছে। বৈকালিক আড্ডা বেশ জমে, দুপুরের আড্ডাও কম নয়। ভরদুপুরে আবদুল হাকিমের দোকানের সামনে বেশ কিছু মানুষের জটলা। সেই জটলার কেন্দ্রীয় চরিত্র এক বৃদ্ধ। নানা বিষয়ে খোশগল্প চলছে।

সেই গল্পের সঙ্গী হয়ে এক ফাঁকে জানা যায়, এলাকার ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যায়। লেখাপড়া না করার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দুর্গম এই চরে বিদ্যুতের পিলার এসেছে, তবে বিদ্যুৎ কবে নাগাদ আসবে, সেটা তাঁদের অজানা। বিদ্যুৎ না থাকায় দক্ষিণ তিলাইয়ের চরে টেলিভিশনের সংখ্যা খুবই কম। তবে বেশ কিছু বাড়িতে টিনের চালে সোলার প্যানেল আছে।

দেশ-বিদেশের খবর তাঁরা খুব একটা রাখেন না, রাখার প্রয়োজনও মনে করেন না। ফলে চরের এই বটতলায় কোনো ধরনের পত্রিকা যায় না। পত্রিকা মিলবে সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে আনন্দবাজারে গেলে। উঠতি বয়সী ছেলে ও তরুণদের মধ্যে কারও কারও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বৃদ্ধ ওই ব্যক্তির ভাষায়, ‘এলাকার কিছু টাউট পোলাপান ফেসবুক ব্যবহার করে।’ এই বক্তব্যের জোরালো প্রতিবাদ জানালেন একাধিক তরুণ। কণ্ঠের ভলিউম আরও একটু বাড়িয়ে বৃদ্ধ চাচা এবার বললেন, ‘টাউট-বাটপার না হলে কি কেউ ফেসবুক ব্যবহার করে?’ এ নিয়ে দুই পক্ষ ভাগ হয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ল। সেই তর্ক-বিতর্কের মডারেটর হওয়ার আশঙ্কায় দ্রুত কেটে পড়ে নিজেকে নিরাপদ মনে হলো।