করোনায় মৃত্যু শুনলেই গাড়ি ভাড়া বাড়ে দু-তিন গুণ

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি লাশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ নেওয়ার জন্য লাশ টানা গাড়ির সঙ্গে ভাড়া ঠিক হয়েছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা। কিছুক্ষণ পরে চিকিৎসক ঘোষণা করেন, এই রোগী করোনায় সংক্রমিত ছিলেন। এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার টাকা।

মৃত ব্যক্তির স্বজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, হাসপাতালের ট্রলিম্যান থেকে শুরু করে একে-ওকে দিয়ে লাশ বাড়ি পৌঁছাতে মোট খরচ পড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ ঘটনা গতকাল বুধবারের।

অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সামনে থাকা লাশ টানা গাড়ির সিন্ডিকেট যার কাছে যে রকম পারছে ভাড়া হাঁকছে। করোনা-কালে তারা একরকম ডাকাতিই শুরু করেছে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভেতরের কোনো ব্যক্তি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তাঁদের লাশ সিটি করপোরেশনের অ্যাম্বুলেন্সে করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আর বাইরের লোকজনকে লাশ টানা গাড়ির খপ্পরে পড়তে হচ্ছে।

হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, চক্রটি এতই প্রভাবশালী যে এই চক্রের গাড়ি ছাড়া এবং তাদের চাওয়া দামের কমে অন্য কোনো গাড়িতে লাশ তোলা যায় না। এ নিয়ে গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় কথা উঠলেও কোনো সমাধান হয়নি। দালাল ও বহিরাগত অ্যাম্বুলেন্সের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণসহ ওই সভায় ১২ দফা আলোচনা হয়। সভায় লাশ বহনকারী গাড়ির জন্য কিলোমিটারপ্রতি নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে টাঙিয়ে দেওয়ার কথা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক এই হাসপাতালে ২০ থেকে ২৫ জন রোগী মারা যায়। ওয়ার্ডে একজন রোগীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির চক্রের লোকেরা খবর পেয়ে যান। তাঁরা ওয়ার্ডে গিয়ে হাজির হন। কোনো গাড়ির মালিক একবার যে ভাড়া হাঁকেন, অন্য কেউ তার নিচে ভাড়া চান না। কারোনা-কালে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

বুধবার সকাল ১০টা ৫৬ মিনিটে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই রোগীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সরাসরি ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। ওয়ার্ডে পাঠানোর পরপরই তিনি মারা যান। তাঁর স্বজন বলেন, ওই ব্যক্তি একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁর কোনো জায়গাজমি নেই। নেহাত গরিব মানুষ। ছোট দুটি ছেলেমেয়ে রয়েছে। বড় মেয়েটা সবে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। অসহায় মানুষটিকে হাসপাতালে শুধু আনাই হলো। কোনো কাজ হলো না। মাঝখানে এতগুলো টাকা দিতে হলো। লাশ টানা গাড়ির লোকজনের হাতে হেনস্তার কথা বলতে গিয়ে তিনি কেঁদেই ফেলেন।

বুধবার রাতে নওগাঁর নিয়ামতপুরের এক ব্যক্তি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তাঁর ছেলে জানান, তাঁর বাবার লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা গাড়িভাড়া নেওয়া হয়েছে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজারের একজন বন কর্মকর্তা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তাঁর ছেলেটা খুব কান্নাকাটি করছিলেন। তাঁরা যেহেতু নগরের কুমারপাড়ায় ভাড়া থাকতেন, সেই সুবাদে তাঁরা সিটি করপোরেশনের অ্যাম্বুলেন্সটা নিতে পেরেছিলেন। তা ছাড়া সবাইকে বাইরের গাড়ি ভাড়া করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, এত ভাড়া নেওয়ার কথা নয়। এমনটা জানতে পারলে সেই গাড়িকে আর হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক বলেন, কীভাবে ভাড়াটা কমিয়ে আনা যায়, সেটা তিনি দেখবেন।