করোনাকালে ফিরে আসা স্মৃতি

প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯১। ফাইল ছবি
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯১। ফাইল ছবি
>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর বাসায় বন্দী। বিশেষ প্রয়োজন না হলে অথবা অফিসে জরুরি কাজে তলব না পড়লে বাসা থেকে বের হওয়া হচ্ছে না। সাধারণ ছুটির সময়ে কর্মস্থল ত্যাগের অনুমতি না থাকায় বাড়িতেও যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অবশ্য বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্তজেলা ভ্রমণ সমীচীনও নয় বটে।

শহুরে বন্দিদশাতেই মা-বাবা আত্মীয়–পরিজন ছাড়া এবার আমার আর আমার স্ত্রীর ঈদ উদযাপন করতে হয়েছে। শৈশব-কৈশোরে কাটানো ঈদের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। বাবা চট্টগ্রামে একটি সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকায় সেই সময়কার ঈদ কাটত চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বাবার অফিসের হাউজিংয়ে। ৮০ থেকে ১০০ পরিবারের সে এক বিশাল ঈদ উদযাপন। রমজান মাস এলেই বসত ঈদ কার্ডের পসরা। চলত বন্ধুদের মাঝে ঈদ কার্ড বিতরণ, ঈদের নতুন জামা ঈদের দিন পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা যাতে কেউ দেখে না ফেলে, ঈদের জামায়াতে সবার আগে উপস্থিত হওয়ার প্রতিযোগিতা, নামাজ শেষ করেই দলবেঁধে সবার বাসায় বাসায় হানা দেওয়া আরও কত কী।

বাসা পতেঙ্গায় হওয়ায় সমুদ্রসৈকত কাছেই ছিল। কিন্তু ওই সময় বাসায় না জানিয়ে আমার জন্য হাউজিংয়ের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, তারপরও একবার এক ঈদের দিন সকালে বাসায় না জানিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্রসৈকতে চলে যাই এবং চেপে বসি নৌকায়। ওটাই ছিল আমার প্রথম নৌকায় চেপে সাগরে ভাসা। ঢেউয়ে প্রচণ্ড দুলুনিতে সবার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যাহোক তারপর বাসায় ফিরে আসা এবং ফিরতে দেরি হওয়ায় কঠিন জেরার মুখে একটু আগে করে আসা অ্যাডভেঞ্চারের স্বীকারোক্তি। ফলাফল অবাধ চলাচলে আরও কঠোর স্থগিতাদেশ আরোপ ঈদের দিন বিকেল থেকেই। এখনকার ঈদে আর কোনো অ্যাডভেঞ্চার করা হয় না। সেই ব্যাপারগুলো আর ফিরেও আসবে না কখনো, সোনালি স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবে। করোনার প্রকোপ না কমলে এবারের ঈদ হয়তো আর দশটা স্বাভাবিক দিনের মতোই কেটে যাবে।

করোনা–কালীন এই বন্দিজীবনে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা উঁকি দিতে থাকে, মনে করার চেষ্টা করি গত বছর এই দিনটা কীভাবে কাটিয়েছিলাম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই মনে করতে পারি না। কারণ জীবনটা অতিসাধারণ, বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। তবে এর মাঝেও কিছু বিশেষ দিন মনকে নাড়া দিয়ে যায় ঠিকই। তেমনই একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চিন্তা করতে থাকি গত বছরের এই দিনের কথা। দিনটা ছিল ২৯ এপ্রিল। মন ফিরে গেল ২৯ এপ্রিলে, তবে গত বছরের নয়, ২৯ বছর আগের ২৯ এপ্রিলে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আমাদের মতো উপকূলবাসীর জন্য কি...এক বিভীষিকাময় দিন হয়ে এসেছিল! এ যেন করোনার মহাদুর্যোগের মাঝে আরেক দুর্যোগের স্মৃতি রোমন্থন। গভীর সমুদ্রে সৃষ্ট নিম্নচাপ, যা পরবর্তী সময়ে শক্তি সঞ্চার করে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে উপকূলের নিকটবর্তী হয় ও আঘাত হানে, তাদের নাম আন্তর্জাতিক আবহাওয়া গবেষণ প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে বর্তমান সময়ে। নামধারী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে সিডর প্রথম আঘাত হানে আমাদের দেশে ২০০৭ সালে। এরপর মহাসেন, তিতলি, ফণীসহ আরও কত ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানল আমাদের দেশে কিন্তু ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আঘাত হানা নামহীন সেই ঘূর্ণিঝড়ের দাগ চট্টগ্রামসহ অন্যান্য উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনে রয়ে গেছে।

লক্ষাধিক প্রাণহানি, সহায়-সম্পত্তির বিপুল ক্ষতিসাধন, বেঁচে যাওয়া মানুষের আর্তনাদের মাঝে আমাদের পরিবার ও ছিল আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপায় বেঁচে যাওয়া একটি পরিবার। একতলা ভবনে আমরা থাকতাম তখন, দ্বিতীয় তলা নির্মাণাধীন ছিল। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় উপকূলীয় এলাকা এবং সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাসের বেগ। রাতে খাওয়াদাওয়া করে সবাই ঘুমিয়েছিলাম, কিছু বুঝে ওঠার আগেই জলোচ্ছ্বাসের পানি প্রবেশ করে প্রবল বেগে, বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য ভেতর থেকে দরজা খোলা যাচ্ছিল না, বাসা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে আমরা একতলার ছাদ ঘরে উঠছি আর পেছন পেছন পানির উচ্চতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাইরে অকল্পনীয় বাতাসের বেগ। ছাদ ঘরের অই অল্প জায়গায় আমরা দুটি পরিবার ঠাঁই নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ভবনের নির্মাণশ্রমিকেরাও ছিলেন, তাঁরা পাশেই অস্থায়ী টিনশেডে থাকতেন, নির্মাণকাজ চলমান থাকায়। ছাদঘরে মাথার ওপর টিনের চালা, তার নিচে কাঠের পাটাতন। বাতাসের তোড়ে সেই টিনের চালা উড়ে যাওয়ার উপক্রম, নির্মাণশ্রমিকসহ সবাই কাঠের পাটাতন শক্ত করে ধরে ছিল। টিনের চালা উড়ে গেলে বাতাসের বেগ হয়তো আমাদের সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যেত। পরবর্তী সময়ে শুনেছি এভাবে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সেদিন আমাদের সঙ্গে নির্মাণশ্রমিকেরা এসে একসঙ্গে আশ্রয় নেওয়ায় সবার প্রচেষ্টায় টিনের চালা ধরে রাখা গিয়েছিল, যা আমাদের দুটি পরিবার একা থাকলে হয়তো সম্ভব হতো না। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ কৃপায় সেদিন আমাদের বেঁচে যাওয়া। দুর্যোগ কেটে গেলে জীবনের তাগিদেই আবার শুরু হয় নতুন করে জীবনচলা, স্বপ্ন বোনা, জীবিকার তাগিদে আবার সেই সাগরেই ঝাঁপিয়ে পড়া, সাগরের লোনা বাতাসে প্রশান্তিবোধ করা, ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দে কানপাতা—এগুলোই সমুদ্রতীরবর্তী মানুষের জীবনের সংগ্রামগাথা।

গত ৯ মে সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলাম আজ ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস’ এবং এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘পাখিতে যুক্ত সমগ্র বিশ্ব’। আসলেই তো তাই, পাখির কোনো দেশ সীমানা বিভেদ নেই, তারা সর্বত্র অবাধ বিচরনশীল। এ জন্যই বুঝি কবি-সাহিত্যিকেরা মাঝে মাঝে পাখি হতে চান, তাদের কবিতা-গান- সাহিত্যে সেই আকুতি দেখতে পাই। করোনাভাইরাসের প্রকোপে দীর্ঘদিন ধরে গৃহে স্বেচ্ছা বন্দী হয়ে আছি। কিন্তু সাধারণ মানুষ হয়েও কবি-সাহিত্যিকের মতো আজ আমারও পাখি হতে ইচ্ছে হচ্ছে, পরিযায়ী পাখি।

দুর্যোগ কেটে যাক, সুদিন আসুক, পরিযায়ী পাখির ন্যায় সবাই ঘর থেকে নির্ভয়ে বেরিয়ে বিচরণ করুক সর্বত্র বিধাতার কাছে এই আর্তি জানাই আজ।

*সহকারী প্রকৌশলী, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল), চট্টগ্রাম