১৩ ঘণ্টা বসে থেকে নমুনা নিয়ে তবেই ফেরেন

বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ
বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ

বরিশালের উজিরপুরের যুগীরকান্দা গ্রাম! করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য বাড়ির দাওয়ায় সেই সকাল থেকে বসে আছেন এক যুবক। কিন্তু বাড়ির লোকজন কিছুতেই নমুনা দেবেন না। তাঁদের এক কথা, পরিবারের এক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর গ্রামের লোকজন তাঁদের ওপর রীতিমতো অত্যাচার চালিয়েছে। সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে কেউ আর নমুনা দিতে চান না তাঁরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পরিবারের সবাইকে বুঝিয়ে শেষে রাজি করান। ১৩ ঘণ্টা বসে থেকে নমুনা জোগাড় করে তবেই ফেরেন।

তিনি উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বিভূতি রঞ্জন বাড়ৈ (৩৬)।

আড়াই মাস ধরে তিনি করোনার নমুনা সংগ্রহ করে চলেছেন। ইতিমধ্যে ২৩২ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভূতির ত্যাগটা অন্য জায়গায়। গত ১৫ মার্চ থেকে করোনার নমুনা জোগাড়ের কাজ শুরুর পর থেকে এক দিনের জন্যও ছুটি নেননি তিনি। বাড়িও ফেরেননি। থাকেন উজিরপুর সদরে সরকারি ডাকবাংলোয়। অথচ করোনাযুদ্ধে নামার দুই দিন আগেই বিয়ে করেছেন। তবে বিভূতির গর্ব তাঁর পরিবারকে নিয়ে। তিনিসহ তাঁর পরিবারের সাত সদস্য এই করোনাকালে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বাকিরা সবাই বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বিভূতির বড় বোন বিউটি রানী বাড়ৈ ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত টিবি হাসপাতালে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেজ বোন নূপুর রানী নার্স হিসেবে আছেন ঢাকার তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নূপুর নিজেই আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। নূপুরের স্বামী স্বপন ওঝা তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার। তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রওশন জাহান আখতার জানান, নূপুর সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন।

বিভূতির সেজ বোন অর্চনা রানী উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্সের দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট বোন রত্না রানীও নার্স। তিনি ঢাকার আবদুল্লাহপুরে আইসি হাসপাতালে আছেন। বড় ভাইয়ের স্ত্রী মনিকা রানী মিস্ত্রী জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে (ইএনটি) নার্স হিসেবে আছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে বিভূতি জানান, তাঁদের বাড়ি উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের বাহেরঘাট গ্রামে। তাঁর বাবা অম্বিকা রঞ্জন বাড়ৈ ছিলেন পল্লিচিকিৎসক। মানুষকে সেবা দেওয়ার মানসিকতা থেকে তাঁর সব ছেলেমেয়েকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

>

বিভূতি রঞ্জনের বাড়ি উজিরপুরে। তিনিসহ তাঁর পরিবারের সাতজন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। করোনাকালে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন সবাই।

বিভূতি সম্পর্কে যুগীরকান্দা গ্রামের করোনাজয়ী লিয়াকত হোসেন সিকদার বলেন, ‘আমি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর গ্রামবাসী ও সমাজ আমার পরিবারের সঙ্গে যে আচরণ করেছিল, তাতে আমরা খুবই হতাশ ছিলাম। পরে ক্ষোভে আমার পরিবারের সদস্যরা নমুনা দিতে চাননি। কিন্তু বিভূতি রঞ্জন যেভাবে সারা দিন বসে থেকে ভালোবাসা ও সম্মান দিয়েছিলেন, তাতে আমার পরিবার অভিভূত। শেষে আমরা সবাই নমুনা দিই।’

নিজের কাজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিভূতি বলেন, শুরুর দিকে উজিরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা নমুনা সংগ্রহে ভয় পাচ্ছিলেন। সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শওকত আলী তাঁকে নিয়ে ১২ জনের নমুনা সংগ্রহ করলেন।

বিভূতির ভাষায়, ‘স্যারের সঙ্গে ১২ জনের স্যাম্পল (নমুনা) সংগ্রহ করার পর আমার মধ্যে সংকোচ, দ্বিধা-ভয় কেটে যায়।’ গত আড়াই মাসে এক দিনও ছুটি নিতে পারেননি। নিয়ম অনুযায়ী, ১৪ দিন দায়িত্ব পালনের পর ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা। কিন্তু কাজের চাপে সে সুযোগ পান না।

উজিরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, টেকনোলজিস্ট বিভূতি রঞ্জন একাই দুই শতাধিক নমুনা সংগ্রহ করে টানা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভূতি সত্যিকারে একজন যোদ্ধা। বিয়ের দুই দিন পর স্ত্রীকে ফেলে রেখে মানুষকে একটানা সেবা দিয়ে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সত্যিই তা প্রশংসার দাবি রাখে।