দেড় মাসেই কৃষকের সর্বনাশ

এফ এইচ আনসারী, কে এ এম মোর্শেদ, এম এ সাত্তার মণ্ডল, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ইলিয়াস মৃধা
এফ এইচ আনসারী, কে এ এম মোর্শেদ, এম এ সাত্তার মণ্ডল, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ইলিয়াস মৃধা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মাত্র দেড় মাসেই দেশে কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। কৃষি খাত ও সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তার ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের করা এক গবেষণায় আর্থিক ক্ষতির এই হিসাব উঠে এসেছে। গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কৃষকের আর্থিক ক্ষতি কত, তার ওপর গবেষণাটি হয়েছে।

করোনার সংক্রমণের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশে সাধারণ ছুটি ছিল। এই সময়ে গণপরিবহন চলেনি, বন্ধ ছিল অফিস–আদালত–মার্কেট। দেশজুড়ে তখন কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ অবস্থা) ছিল। লকডাউন চলা অবস্থায় ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকেরা।

দেশের ৬৪ জেলার ১ হাজার ৫৮১ জন কৃষকের (ফসল, শাকসবজি, হাঁস–মুরগি ও মাছ এবং দুগ্ধ উৎপাদনকারী) ওপর গবেষণাটি করেছে ব্র্যাক। গবেষণা বলছে, মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে পরের দেড় মাসে পণ্যের ক্ষতি ও কম দামের কারণে প্রত্যেক কৃষকের লোকসান হয়েছে গড়ে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৯৭৬ টাকা। সেই হিসাবে সারা দেশে কৃষির প্রতিটি উপখাতের সব কৃষকের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে ওই দেড় মাসে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে আলোচক হিসেবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য এম এ সাত্তার মণ্ডল, প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা, এসিআই অ্যাগ্রিবিজনেসের নির্বাহী পরিচালক এফ এইচ আনসারী এবং ব্র্যাকের ডেইরি অ্যান্ড ফুড এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। এ ছাড়া অনলাইনে যুক্ত হয়ে দুজন কৃষক তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ।

ব্র্যাকের গবেষণা: করোনা সংক্রমণের প্রথম দেড় মাসে কৃষকের ক্ষতি ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

গবেষণায় দেখা গেছে, সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেতে চান ৬৬ শতাংশ কৃষক। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার কথা বলেছেন ৫৬ শতাংশ কৃষক। আর কম খরচে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ চান ৪৮ শতাংশ কৃষক। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৬৪ শতাংশ কৃষক সরকারঘোষিত প্রণোদনার কথা জানেন। তবে এই সুবিধা কীভাবে পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে ৭৯ শতাংশ কৃষকের ধারণা নেই বা ভুল ধারণা আছে।

সংকট নিরসনে গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, লালফিতার দৌরাত্ম্য ও পদ্ধতিগত বাধাগুলো কমিয়ে ঋণ বিতরণ ব্যবস্থাকে কৃষকবান্ধব করা, সৃজনশীল বিতরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন (এমএফএস, এনজিওগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ) করা। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা বাড়িয়ে বাজারকে প্রাণবন্ত রাখতে নগদ অর্থ বিতরণ কার্যক্রম জোরদার এবং ক্ষুদ্র কৃষকের কাছে সরাসরি ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন অন্যতম।

গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর আলোচনায় পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, এই সংকট সামাল দিতে আড়তদার, পাইকার, ফড়িয়া এদেরও গুরুত্ব দিতে হবে, সবাইকে কাজে লাগাতে হবে। কেননা, বাজারে এদের বিরাট ভূমিকা থাকে।

সরাসরি প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করা এখনো কঠিন বলে জানান প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা। কৃষিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য যেসব এলাকায় সংক্রমণ কম সেসব এলাকায় মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন তিনি।

এসিআই অ্যাগ্রিবিজনেসের নির্বাহী পরিচালক এফ এইচ আনসারী বলেন, কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাত, ডিলার এবং সম্প্রসারণ সেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের উন্নতি ঘটাতে সরকারের ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

ব্র্যাকের সমীক্ষা অনুযায়ী, সরকারি ছুটির কারণে রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় পোলট্রি চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন, মুরগির দাম কমে যায় ৪৪ শতাংশ। চাহিদা কমার কারণে পোলট্রি খামারিরা উৎপাদনও কমিয়ে দেন। দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকের পণ্যের চাহিদা ৩৩ থেকে ৬০ শতাংশ হ্রাস পায় এবং খুচরা স্তরে গড়ে দাম সাড়ে ১২ শতাংশ কমে যায়। দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকদের ১৬ শতাংশ তাঁদের উৎপাদন কমিয়ে দেন।

গবেষণার ফল প্রকাশের অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের ডেইরি অ্যান্ড ফুড এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, মহামারি শুরুর পর ব্যাপকহারে চাহিদা কমায় চাষিদের সবজি, দুধ নষ্ট হয়েছে। এই পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি এর প্রভাব শুভ হবে না। কৃষকেরা কৃষিকাজ ছেড়ে দিলে বা কমিয়ে ফেললে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।