উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

২৪ মার্চ থেকে স্বেচ্ছাবন্দী পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে! গুনে গুনে ৭৪ দিন! মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে পরিবেশ আইনে মাস্টার্স করতে গিয়েছিলাম স্কলারশিপ নিয়ে। শেষ করে মার্চে ফিরেছি শিক্ষা ছুটির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার কিছু আগেই। পরিবেশ আইনের বাঘা বাঘা অধ্যাপক ও বিজ্ঞানীদের ক্লাস আর সেমিনারগুলোতে গর্বে বুক ফুলে উঠত, আহা! কত কিছু শিখছি! কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এর চেয়েও বড় কোর্স অপেক্ষা করে আছে দেশে, লকডাউনের কোর্স!

ইকুয়েডর সংবিধানে প্রকৃতির টিকে থাকার ও বিকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বড় বড় পরিবেশবিষয়ক সম্মেলন যা পারেনি, করোনার অসিলায় Mother Nature কী, তা–ই করে দেখিয়ে দিলেন যে দূষণমুক্ত পৃথিবীর চেয়ে আর কোনো কিছুই অগ্রগণ্য নয়? কীভাবে পরিবেশকে সমুন্নত রাখতে হয়?

লকডাউনে সারা দিন ঘরের ভেতর হাঁসফাঁস করছিলাম। বিকেলে এসে দাঁড়ালাম ব্যালকনিতে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকি। অনতিদূরেই বস্তি থেকে ভেসে আসে ভয়ডরহীন শিশুদের কলকাকলি। গ্রিলের বাইরের ফাঁকা পৃথিবীটা আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে! বিদ্রূপ মেশানো হাসিতে সে ছুড়ে দেয় একরাশ প্রশ্নের বাণ—

‘অবশেষে বুঝল কি মানুষ স্বাধীনতা মানে কী? বন্দিত্বের কষ্ট উপলব্ধি করল কি কিছুটা খাঁচায় পোষা পাখিপ্রেমীরা? আহা! করোনা কি পারল বোঝাতে—মা–বাবার সঙ্গে একান্নবর্তী জীবন কী ভীষণ মধুর! বৃদ্ধাশ্রম এক অমানবিক যন্ত্রণাবাস? মধ্যবিত্ত বুঝল কি তবে বিত্তহীনের অসহায়তা? উচ্চবিত্ত মানল কি তবে, অর্থই নয় নিরাপত্তা?’

কী এক ঘোরের মধ্যে ডুবে যাই অকস্মাৎ! বাইরের পৃথিবীর জীবনানন্দীয় এই নিস্তব্ধতা উটের গ্রীবার মতো আমার গ্রিলের ফাঁকে আবির্ভূত হয়ে জিজ্ঞেস করে—
‘কী হে, করোনামুক্ত পৃথিবীতেও কি মানুষ স্বজাতির খুনে রাঙাবে হাত জাগতিক প্রাপ্তির আশায়? দেখব কি চ্যালাচামুন্ডা-ক্যামেরাহীন একজন নেতা একাকী হেঁটে চলেছেন অসহায় মানুষের খোঁজে? দেখব কি সদ্যমৃত রোগীর পাশে বিষণ্নবদন চিকিৎসক বাঁচাতে না পারার আফসোসে মাথা নাড়ছেন ঘনঘন, আর তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সেই মৃতের স্বজন? সেই করোনাহীন পৃথিবীতে একজন উচ্চপদস্থের সামনে রাখা চেয়ারে অনায়াসে বসে যেতে পারবেন তো একজন সাধারণ দর্শনার্থী? নাকি শুধু বিধাতার সামনেই বসা যাবে এ নিয়ম থাকবে অটুট? দেখব কি রাত তিনটায় নির্জন রাস্তায় একা মেয়েটিকে আপন বোনের মতো বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে অচেনা যুবক? আহা! করোনা কি পারল ঘোচাতে ধর্মে-ধর্মে কর্মে-কর্মে ভেদাভেদ? কোনো এক বৃষ্টিস্নাত রংধনুময় বিকেলে দেখব কি মেথর কিশোরীর চুলে শোভা পাচ্ছে সম্ভ্রান্ত যুবকের গুঁজে দেওয়া ভালোবাসাময় ফুল?’

সংবিৎ ফিরে পাই মায়ের ডাকে। যাওয়ার আগে আমি সেই নিস্তব্ধতার কানে আবৃত্তি করে যাই মৃদুস্বরে-
কতিপয় দানবীয় অ-কবির হাতে
বন্দী পৃথিবী-কবিতা-খাতা!
সীমান্তে হত্যা তো অনুপ্রাস
ক্ষুধাহীন দারিদ্র্য-মুক্ততা উৎপ্রেক্ষা মাত্র!
অস্ত্রের অর্কেস্ট্রায় ছন্দময় মৃত্যুমিছিল!
মানুষে মানুষে টানা
ধর্ম, বর্ণ, পুঁজিবাদের যতিচিহ্ন—
দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন!
রক্ত-কালিতে লেখা
করোটি-অক্ষরে সাজানো
এ পৃথিবী আজ সবচেয়ে মর্মন্তুদ কবিতা!