করোনাকাল ও নগরজীবনে সেন্স অব এম্প্যাথি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

দুই মাস পার হলো ঘরকে তীর্থস্থান বানিয়ে একরকম সাধুটাইপ জীবন যাপন করে চলছি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে ভাবলেশহীন মুখ করে মাঝেমধ্যে বারান্দায় বসে থাকি আর রাস্তায় কাউকে দেখলে আঁতকে ওঠার ভাব করে সহধর্মিণীকে ডাক দিয়ে সেই সাহসী পথচারীকে দেখাই। যদিও মনে মনে আনন্দিত হই এই ভেবে যে পরিস্থিতি হয়তো আস্তে আস্তে স্বাভাবিকের দিকে মোড় নিচ্ছে অথবা মানুষ ঘাড়ত্যাড়া ভাব নিয়ে ঘরছাড়া হতে চাচ্ছে।
আসলে প্রত্যহ পায়ে পায়ে শহর মাড়ানো নাগরিকেরা হাপিত্যেশ করছে একটুখানি আগের মতো হতে অথবা পাশের বাড়ির আঙ্কেলের মতো জাম্প কেডস পরে ঘরের ভেতর জগিং করার অভিনয় করতে। কী এক অদ্ভুত ফিসফিসানি ডিলেমায় নিমজ্জিত হয়ে আছে আমাদের নগরজীবন। ঠিক অর্ণবের গানের কথার মতো, ‘গোটা শহর বাতি জ্বেলে সতর্ক’।
শিক্ষিত শ্রেণির জন্য ঘরে থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনা-সচেতন নাগরিকের অভিনয় না করলে জাত যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে, বাইরে বের হলে তা চুপিসারে করতে হচ্ছে, পাছে লোকে বেকুব অথবা ‘শ্রমিক নাকি’ তকমা না দিয়ে দেয়! নগরজীবনকে অদ্ভুত এক ‘মুশকিলে-না-আসান’ অবস্থায় ফেলে দিয়েছে এই গণতান্ত্রিক ভাইরাস। এরই মধ্যে শহরের কোনো এক প্রান্তে কেউ টিনের চালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টায় ওষ্ঠাগত, আবার কেউ স্টেট অব দ্য আর্ট স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে বসে নেটফ্লিক্সের ৫: ১ প্যাকেজ কেনার জন্য পার্টনার না খুঁজে পাওয়ার হতাশায় নিমজ্জিত।

আসলে এই শহরে মহামারিও আসে উপলক্ষ নিয়ে, কেউ ন্যাড়া হয়ে মাথায় অ্যালোভেরা জেল লেপে দেয়, কেউ বিউটি পারলার খুলে দেওয়ার করুণ (!) আরজি নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে কান্না জুড়ে দেয়, কেউ অনলাইনে একসঙ্গে ৫০০ সার্জিক্যাল মাস্কের অর্ডার করে, আবার এক বাবা প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে ব্যবহৃত কাপড়ের ২ পর্দার মাস্কটি সযতনে ধুয়ে কখনো আলোর মুখ না দেখা স্যাঁতসেঁতে বারান্দায় নেড়ে দেয়।
এই করোনাকালে আরেক অদ্ভুত উপদ্রব শুরু হয়েছে, তা হচ্ছে বারবার হাত ধোয়া। সারা রাত গেমস খেলা, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ওয়ালেট বোঝাই করা, অনলাইনে পিৎজা অর্ডার করা এবং কালেভদ্রে গোসল করা শহুরে মিলেনিয়াল জেনারেশনের জন্য পরিচ্ছন্নতার এই নব্য ধারা ভারী অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অনেক মা–বাবার অভিযোগ, সন্তান গোসল করে না কিন্তু বারবার হাত ধোয়। যাহোক, জোক্স অ্যাপার্ট, আমার করোনাকাল নিয়ে কথাবার্তায় আসি।

১.
করোনাকালে আমার গল্পে কুশীলব আমি ও আমার সহধর্মিণী ছাড়াও আরও ৩ জন আছে। আমাদের বাসার কেয়ারটেকার ওয়াসিম, কুসুম; আমাদের ঠিকা বুয়া আর সর্বশেষে আছে নামহীন একটি কঙ্কালসার কুকুর। ওয়াসিম স্বভাবে অত্যন্ত চঞ্চল, করোনাকে থোড়াই কেয়ার তার, অন্যদিকে কুসুম অত্যন্ত ঠান্ডা প্রকৃতির ও বাস্তববাদী মা যে জীবনযুদ্ধের ময়দানে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে বেশ আগেই নেমে গেছে। আর কুকুরটির সঙ্গে দেখা কোনো এক বৃষ্টিস্নাত দুপুরে, আমাদের কলাপসিবল গেটের সামনে জবুথবু হয়ে বসে ছিল। খুব মায়া লেগেছিল ওর জন্য। এলাকার হোটেল, চায়ের টং—সবকিছু বন্ধ থাকায় ওর কপালে বোধ হয় উচ্ছিষ্ট জুটছিল না। তাই খিদের জ্বালায় খাবার খুঁজতে খুঁজতে কোনো এক ফাঁকে আমাদের বাসার মেইন গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছিল। তো যে ব্যাপারটা ঘটল, সেটা হলো আমাদের ওয়াসিম খুব রিঅ্যাক্ট করল ওকে দেখে, তাড়ানোর জন্য উদ্যত হলো। আমরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘থাক না ও। অসুবিধা কী? আমাদের খিদে লাগলে আমরা তো মুখ ফুটে চাইতে পারি, ও তো তা–ও পারে না।’ ওয়াসিম জবাবে বলল, ‘স্যার, পশুপাখির সাথে বেশি না মেশাই ভালো, বড্ড মায়ার জিনিস।’ এর পরদিন এক অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হলো, কুকুরটা আমাদের বাসা পাহারা দেওয়া শুরু করল আর ওয়াসিমও ওকে ঘটা করে খাবার দেওয়া শুরু করল। ওদিন আমাদের কুসুমকে ঢুকতে দেখে ওর পেছনে লাগল খুব করে। জানি না এটা কীভাবে সম্ভব হলো, আমি বাইরে গিয়ে কুকুরটার উদ্দেশে বললাম, কুসুমকে ভয় দেখাবি না। তার পরদিন থেকে কুসুমকে দেখলে ও কিছু করত না। যাহোক, এই কুকুরকে নিয়ে ফ্ল্যাটের বাকি সবার আগ্রহের সৃষ্টি হলো, সবাই ওকে নিয়ে দিনের কিছুটা সময় পার করা শুরু করল। ওর মাধ্যমে একটা সেন্স অব এম্প্যাথি গ্রো করল আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় এ ব্যাপারটাকে বোধ হয় ‘কালেকটিভ কনসায়েন্স’ বলে।

২.
সরকারি কলোনিতে থাকার দরুন কিছুটা খোলামেলা পরিবেশে বসবাসের সুযোগ হয়েছে। আশপাশে অনেক গাছগাছালি রয়েছে। এ ছাড়া বাসার মেইন গেটের ভেতরে কিছুটা ফাঁকা জায়গাও আছে, যেখানে আমরা কিছু ফুল গাছ লাগিয়েছিলাম গেল শীতে। তাহলে বাকি জায়গাটুকুতে সবজিবাগান করাই যায়। যেই কথা সেই কাজ। ও বলা তো হয়ইনি, আমার সহধর্মিণী একজন মৃত্তিকাবিজ্ঞানী। সব মিলিয়ে সবজি চাষ করার জন্য একেবারে সোনায় সোহাগা অবস্থা। কাঁচা মরিচ, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ঢ্যাঁড়স—আরও কত কী! মজার ব্যাপারটা ঘটল যখন পরিচর্যার বিষয় এল। এখানেও সেই সেন্স অব এম্প্যাথির খেলা। ওয়াসিমসহ ফ্ল্যাটের অন্যদেরকেও মাঝেমধ্যে খুব যত্ন দিয়ে গাছে পানি দিতে দেখি পর্দার আড়াল থেকে। মহামারির এই অস্থির কালে কী এক অদৃশ্য বন্ধনের সৃষ্টি হলো এক সবজিবাগান করে!

৩.
কালবৈশাখী একালে ভরদুপুর থেকে সন্ধ্যার ভেতর হানা দিচ্ছে। আগে অফিসের থাই গ্লাসের ভেতর থেকে দু–একটা নারকেলগাছের পাতার হুড়োহুড়ি দেখে বুঝতাম কালবৈশাখী শুরু হয়েছে। মাঝেমধ্যে বাড়ি ফেরার বাসের ভাঙা জানালাটি দিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত চোখে কালবৈশাখীর তাণ্ডব দেখতাম। এ কারণে উপভোগ করে কালবৈশাখী দেখার সৌভাগ্য এই নগরজীবনে খুব একটা হয়নি। এবার এই করোনাকালে, বাসার বারান্দায় আরামকেদারায় বসে কালবৈশাখী দেখছি খুব। যাহোক, আগেই বলেছি আমার বাসার আশপাশে কয়েক পদের গাছ রয়েছে, তন্মধ্যে আমগাছ উল্লেখযোগ্য। একদিন দেখলাম, ঝড়ের মধ্যে বড়–ছোট কিছু মাথা আমবাগানের ভেতর ঘোরাঘুরি করছে। আরেকটু খেয়াল করে দেখি, পুরোদমে আম কুড়ানো চলছে, কেউ গামলা নিয়ে, কেউ ওড়নার ভাঁজে, কেউবা খালি হাতে। বলে রাখা ভালো, আমাদের কলোনির গা ঘেঁষে একটি বস্তি রয়েছে। কী মনে করে আমি আমাদের ওয়াসিমকে ফোন করে বললাম, এরা কারা—খোঁজ নিয়ে জানাও। ওয়াসিম কিছুক্ষণ বাদে আমার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলল, ওদের নাকি আম কুড়ানোর অনুমতি ও নিজেই দিয়েছে। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, আচ্ছা, ভালো করেছ, কিন্তু আমাদের অনুমতি নিয়ে কাজটি করলে খুশি হতাম। ওয়াসিম আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমাদের কুকুরটার ভাগ্য ওদের থেকে ভালো, ওর পেট ছোট আর তিন বেলা খাবার পাচ্ছে, আমকুড়ানিরা তো তিন বেলা খাবারই পায় না।’ আমি মুচকি হাসি দিয়ে ওকে বিদায় দিলাম, ওকে বুঝতে দিলাম না, ওর কথাটা আমাকে কী পরিমাণে নাড়া দিয়েছে।
* গবেষণা সহযোগী, বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)। [email protected]