করোনা পরীক্ষায় নমুনা সংগ্রহের আওতা বাড়ানোর তাগিদ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজধানীতে যেসব সরকারি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার অধিকাংশতেই সরাসরি নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা নেই। নমুনা সংগ্রহের বুথের সংখ্যাও অপ্রতুল। আবার একটি বুথে দিনে সর্বোচ্চ ৩০টি নমুনা নেওয়া হচ্ছে। এসব বুথ কোথায় অবস্থিত, সেটি নিয়ে প্রচারণাও কম। ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির এই সময়ে সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

অন্যদিকে ঢাকার বাইরের পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে দক্ষ লোকবলসংকট থাকায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংগ্রহ করা নমুনা অপরীক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ফলে পরীক্ষার ফলাফল পেতে সময় বেশি লাগছে।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ও জেকেজি বুথের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করছে। কোথায় কোথায় এসব বুথ রয়েছে, সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট এবং করোনাবিষয়ক সরকারি ওয়েবসাইটে দেওয়া নেই। ফলে লোকজন বাধ্য হয়ে পরিচিত চিকিৎসক, সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করছেন কোথায় নমুনা দেওয়া যাবে। সরকারি হটলাইনে ফোন করেও কেউ কেউ খোঁজ নিচ্ছেন।

দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি ৫০টি কেন্দ্রের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২৭টি এবং ঢাকার বাইরে ২৩টি। ঢাকায় নতুন যুক্ত হওয়া কেন্দ্রগুলোর ১১টিই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৬০ হাজার ৩৯১ জন। গত কয়েক দিন ধরে দিনে ১১ থেকে ১২ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা হয়েছে ১৪ হাজার ৮৮ জনের।

পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশে প্রতি ১০ লাখে ২ হাজার ২৬৩ জনের নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষার সংখ্যা ও আওতা আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।

গত ১৪ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জানান, শিগগির করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা দৈনিক ১৫ হাজারে উন্নীত করা হবে। পরীক্ষার জন্য নতুন আরও ১৫টি ল্যাবরেটরি করা হচ্ছে। মন্ত্রীর ঘোষণার পর ২৩ দিন পার হলেও পরীক্ষা দৈনিক ১৫ হাজারে পৌঁছায়নি। এই সময়ে নতুন ১১টি ল্যাবে পরীক্ষা শুরু হলেও এর মধ্যে ৭টিই বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

>

• এখন চালু সরকারি-বেসরকারি মোট পরীক্ষাকেন্দ্র ৫০টি।n ঢাকায় ২৭টি এবং ঢাকার বাইরে ২৩টি কেন্দ্র।
• ঢাকায় নতুন যুক্ত হওয়া কেন্দ্রগুলোর ১১টিই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করালে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ও হাসপাতাল প্রতিনিধি বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে সাড়ে ৪ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার পেছনে চিকিৎসক ফি, ডেঙ্গুর পরীক্ষা একসঙ্গে করাসহ বিভিন্ন কারণ বলা হচ্ছে।

নমুনা দেওয়া নিয়ে ভোগান্তি

রাজধানীতে যে ২৭টি কেন্দ্রে নমুনা পরীক্ষা করা হয়, তার মধ্যে ১১টি বেসরকারি হাসপাতাল ও পরীক্ষাকেন্দ্রে সরাসরি নমুনা দেওয়া যায়। সরকারি কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অনলাইনে নিবন্ধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলে সরাসরি নমুনা দেওয়া যায়। বাকি কেন্দ্রগুলোতে সরাসরি সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয় না।

ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ৩০টি জায়গায় নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপন করেছে। বেসরকারি সংস্থা জেকেজির বুথ রয়েছে পাঁচ জায়গায়। নমুনা সংগ্রহ করে তারা সরকার নির্ধারিত কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। কোথায় কোথায় এসব বুথ রয়েছে, সেটি নিয়ে প্রচার না থাকায় সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা দেওয়া নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

ব্র্যাক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় হাসপাতালের বাইরে সাতটি বুথে নমুনা সংগ্রহ করছে গত ১৪ মে থেকে। প্রতিটি বুথে দিনে ৩০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, যে পরিমাণ লোকজন পরীক্ষার জন্য আসছেন, সে তুলনায় বুথ কম। ভোরবেলা এসে দাঁড়াতে হচ্ছে লাইনে। অনেকে নমুনা না দিতে পেরে ফিরে যাচ্ছেন। তাই ডিএনসিসির পক্ষ থেকে বুথ বাড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পরীক্ষা বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এর অংশ হিসেবেই বেসরকারি সামর্থ্য যোগ করা হচ্ছে। আরও কয়েকটি কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নমুনা সংগ্রহের বুথের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।

নমুনা না পাওয়ায় কেন্দ্র বন্ধের পথে

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) করোনা শনাক্তের পরীক্ষা শুরু হয় গত ১৭ এপ্রিল। এই কেন্দ্রে দৈনিক ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। কেন্দ্রটিতে যশোর, নড়াইল, মাগুরা ও ঝিনাইদহ—এই চার জেলার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। কেন্দ্রটির দৈনিক নমুনাপ্রাপ্তি ও পরীক্ষার তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১১ মে থেকে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা একেবারেই কম। গত ২৪ দিনে এই কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৪১৩টি নমুনা।

যবিপ্রবির জিনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ইকবাল কবির প্রথম আলোকে বলেন, গত মাসের ১০ তারিখ থেকে দিনে ২০ থেকে ২৫টি নমুনা দেওয়া হচ্ছে। নমুনা না দেওয়া হলে দু-এক দিনের মধ্যে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিতে হবে। সংক্রমণ বৃদ্ধির এই সময়ে নমুনার অভাবে একটি পরীক্ষাকেন্দ্র বন্ধ হবে, এটা প্রত্যাশিত নয়।

কেন্দ্র–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১১ মে থেকে শুধু যশোর জেলার সংগ্রহ করা কিছু নমুনা এই কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। নড়াইল, মাগুরা ও ঝিনাইদহ থেকে নমুনা এই কেন্দ্রে আসছে না। সেসব জেলার নমুনা খুলনার পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। এতে খুলনার কেন্দ্রে পরীক্ষার চাপ বাড়ছে। সংগ্রহ করা অনেক নমুনা অপরীক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক রাশেদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, যশোরের কেন্দ্রটি কিছুদিন বন্ধ থাকায় নড়াইল ও মাগুরার নমুনা খুলনায় পাঠানো হয়। নড়াইল ও মাগুরা জেলা নমুনা খুলনাতেই পরীক্ষা করাতে চায়। যশোর ও ঝিনাইদহের নমুনা থেকে দৈনিক ৫০টি নমুনা যশোর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হবে।

সরকার গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে যে কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা হচ্ছে, সেগুলোতে ২০ থেকে ২৫ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব। সে জন্য লোকবল ও সহায়তা বাড়াতে হবে। নমুনা সংগ্রহের বুথের সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে হবে। প্রতিটি বুথে সংগ্রহকারীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। বুথ ও সংগ্রহকারীর সংখ্যা বাড়লে জনগণের ভোগান্তি অনেকটাই কমবে।