করোনার মধ্যেও ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রায় ২০০ মামলা

নারী নির্যাতন। প্রতীকী ছবি
নারী নির্যাতন। প্রতীকী ছবি

করোনা–বন্ধের মধ্যেও ঢাকা মহানগরে নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রায় ২০০টি মামলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ধর্ষণসংক্রান্ত, তারপর যৌতুক ও অপহরণের। সেবাদাতা আর অধিকারকর্মীরা বলছেন, হাসপাতাল বা থানায় যাওয়া কঠিন ছিল, গণমাধ্যমেরও মনোযোগ ছিল মহামারিতে। ঘটনা সম্ভবত আরও বেশি।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতায় রাজধানীর ৫০টি থানায় হওয়া মামলার মূল বিবরণ থাকে। এ প্রতিবেদক গত ২৬ মার্চ থেকে ৩ জুনের হিসাব খতিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের অন্তত ১৯৭টি মামলার হদিস পেয়েছেন।

এগুলোর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৫৬টি এবং গণধর্ষণের ৮টি। ধর্ষণচেষ্টার মামলা আছে ১৪টি। যৌতুকসংক্রান্ত নির্যাতনে মামলার সংখ্যা ৫১। লকডাউনের মধ্যেও অপহরণের ৩৬টি মামলা হয়েছে। শ্লীলতাহানির মামলা ১৮টি। সাতটি মামলা হয়েছে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা এই মামলাগুলো বাদে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরও সাতটি মামলা হয়েছে।

ফাহমিদা আক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী। সেন্টারটি নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য। ফাহমিদা বলছেন, প্রতিদিনই সেন্টারে ভুক্তভোগী কেউ না কেউ আসছেন।

বহু বছর ধরে নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে কাজ করা এই মানবাধিকারকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনের এই সময়েও ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা মোটেও কমেনি। প্রতিদিনই ঘরের ভেতর নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।’

গত মে মাসে যৌন নির্যাতনের শিকার ২৩ জন নারী ওসিসিতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনজন। আরও ১৮ জন হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন।

>

রাজধানীতে মামলার হিসাব বলছে, লকডাউনে মূলত ঘরের মধ্যে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন চলেছে। এটা আংশিক চিত্র।
গ্রাফিক্স নিউজের ভেতরে যাবে।

ওসিসির সমন্বয়ক বিলকিস বেগম বলছেন, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি থাকায় গণপরিবহন বন্ধ ছিল। অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েও হাসপাতাল, থানা বা আদালতে যেতে পারেননি। করোনা সংক্রমণের ভয়ে অনেকে হাসপাতালে আসেননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, লকডাউন ওঠার পর এখন অনেকে ওসিসিতে আসছেন।

এদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলছেন, পুলিশের কাছে অপরাধের যে রিপোর্ট আসে, তার বাইরে অনেক ঘটনা থাকে। প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা করোনার পরিস্থিতিতে নানা কাজে ব্যস্ত। নারী ও শিশু নির্যাতনের দিকে মনোযোগ কিছুটা কমে যেতে পারে।

সাবেক এই আইজিপি বলেন, মহামারির কালে পশ্চিমা বিশ্বে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। এ দেশেও তেমনটা ঘটা সম্ভব। গৃহবন্দী মানুষের আয় কমে গেছে, নানান হতাশা রয়েছে। নারী ও শিশুদের নির্যাতনের ঝুঁকি বাড়ছে। এখন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

গৃহবন্দীকালে ধর্ষণ ও নির্যাতন

এ প্রতিবেদক গত আড়াই মাসে দায়ের হওয়া ধর্ষণসংক্রান্ত ৭৮টি মামলার মধ্যে অন্তত ১৪টির কাগজপত্র খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। প্রবণতা বলছে, ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা মূলত ঘরের ভেতরে পরিচিত মানুষদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকেই তারা শিশু গৃহকর্মী।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় তৌহিদুল ইসলামের (৩০) বাসায় গত জানুয়ারি মাসে গৃহকর্মী হয়ে আসে ১৫ বছর বয়সী একটি মেয়ে। মেয়েটি গত ৮ মে বাড্ডা থানায় গৃহকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছে। অভিযোগ, কাজে যোগদানের পর থেকে গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তৌহিদুল একাধিকবার তাকে ধর্ষণ করেছেন।

এজাহারে মেয়েটি লিখেছে, স্ত্রী কাজে বেরোলে হত্যার ভয় দেখিয়ে তৌহিদুল তাকে ধর্ষণ করতেন। পুলিশ গত ৯ মে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি এখন কারাগারে আছেন। বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. বশিরুল ইসলাম আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে লিখেছেন, আসামির স্বভাবচরিত্র ভালো না। তিনি গৃহকর্মী কিশোরীকে ধর্ষণ করেছেন। সে এখন দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

গত ২৮ মে বাবার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেছেন ১৮ বছর বয়সী একজন নারী। এজাহারে দেখা যায়, তাঁর মা নেই। তিনি বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। পরে বাবার কাছে আশ্রয় নেন।

গত ডিসেম্বর মাস থেকে বাবা তাঁকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করছিলেন। উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. আলমগীর গাজী প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনেও এ নির্যাতন চলছিল। মেয়েটি মামলা করার পর বাবা পালিয়েছেন। তাঁকে ধরতে অভিযান চলছে।

রাজধানীর পল্টন এলাকায় একটি বাসায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে চার হাজার টাকা বেতনে কাজ নিয়েছিল ১২ বছর বয়সী একটি মেয়ে। গত ২৯ মে তার বড় বোন পল্টন থানায় একটি মামলা করেন। এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, আসামি গৃহকর্ত্রী আসমা আক্তার ওরফে রুমা ও তাঁর কিশোর ছেলে গত ১৫ মে মেয়েটির গায়ে গরম পানি ঢেলে দেন।

মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। এ ছাড়া আসামিরা তাকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেন। প্রথম আলোর কাছে মেয়েটির আহত-ক্ষতবিক্ষত অবস্থার ভিডিও চিত্র আছে।

বড় বোন প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটিকে কোনো বেতনও দেওয়া হয়নি। বোন বলেন, আসামিরা পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করেছে। এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। মেয়েটি ৪ মে সিএমএম আদালতে জবানবন্দী দিয়ে বিবরণ জানিয়েছে।

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন নারী কর্মকর্তা এবং পুরুষ কর্মকর্তার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ওই নারী কর্মকর্তা গত ২০ এপ্রিল পুরুষটির বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা করেন। তাঁর এজাহার অনুযায়ী, আসামি তাঁকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি আসামি তাঁর এবং আরও কয়েকজনের মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছেন। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে সবাই ঘরে রয়েছেন। অনেক পুরুষের আয়রোজগার বন্ধ। নানা রকম কারণেই নারী ও শিশুর ওপর যৌন ও অন্যান্য নির্যাতন চলছে। দ্রুত তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা খুব জরুরি।