দূরে থেকেও গ্রামে বাড়িয়েছেন সহায়তার হাত

প্রবাসী মনজুর হোসেনের অর্থ সহায়তায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ছবিটি সম্প্রতি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের হামিদপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
প্রবাসী মনজুর হোসেনের অর্থ সহায়তায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ছবিটি সম্প্রতি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের হামিদপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

এই টানটাকেই হয়তো বলে মাটির মায়া। যত হাজার কিলোমিটার দূরেই অবস্থান হোক, নিজের গ্রাম বুকের ভেতরে নীরবে-নিভৃতে থেকেই যায়। যখনই সেই জন্মগ্রামে দুর্যোগ আসে, দুর্ভোগে পড়ে গ্রামবাসী, বুকের অতল থেকে জেগে ওঠে সেই সবুজ-শ্যামল গ্রামটি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সব মানুষের মুখ। 

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের হামিদপুর এ রকমই একটি গ্রাম। আর এ গ্রামেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা মনজুর হোসেনের (৩৪)। একপাশে প্রবহমান কুশিয়ারা নদী, অন্য পাশে বিস্তীর্ণ জলরাশির কাউয়াদীঘি হাওর। তার মধ্যখানে ছবির মতো গ্রামটি আর ১০টা গ্রামের মতো মানুষকে কোল দিয়ে আগলে আছে। কিন্তু জীবিকার সন্ধান মনজুর হোসেনকে এই গ্রাম থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের এক দেশে নিয়ে গেছে। থাকেন পর্তুগালে। নিশ্চিত এক জীবন। গ্রামের দিকে না তাকালেও তাঁর কিছু যায়-আসে না। তবু গ্রামটিকে তিনি ভোলেননি। ভোলেননি গ্রামের মানুষকে। দূরে থেকেও করোনাভাইরাসের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে হাত বাড়িয়েছেন গ্রামের মানুষের দিকে।


ওই প্রবাসী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হাওর ও নদী পারে বেড়ে ওঠা মনজুর হোসেন ২০১৩ সালে পাড়ি জমান পর্তুগালে। ওখানেই পরিবার নিয়ে এখন তাঁর বাস। তার আগে ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে। এক অর্থে তারুণ্যের শুরু থেকেই তিনি প্রবাসী। দেশের মানুষ, দেশের নানা ঘটনা থেকে তিনি অনেক দূরে। কিন্তু দেশটাকে কখনোই ভুলতে পারেন না। ভুলতে পারেন না জন্মগ্রহণ করা গ্রামটিকেও। নানা দৈবদুর্বিপাকে, মানুষের বিপদে-আপদে সব সময়ই হাত বাড়িয়ে থাকেন। গ্রামের মানুষের মুখ কাজের অবসরে তাঁকে সব সময় তাড়া দেয়। সুযোগ পেলেই কিছু না কিছু নিয়ে সেই দূরত্ব তিনি ঘুচিয়ে ফেলেন।


সম্প্রতি করোনাভাইরাস সংক্রমণে মানুষ ঘরবন্দী, গ্রামবন্দী। অনেকের কাজ নেই। অনেকের হাতে নগদ টাকা নেই। মানুষ কষ্টে আছে। বিভিন্ন মাধ্যমে তা তাঁর কানে পৌঁছায়। মনজুর হোসেন কথা বলেন বাড়িতে থাকা মায়ের সঙ্গে, বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁরাও তাঁর আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে সমর্থন করেন। পরে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় মে মাসের শেষ দিকে এলাকার চার শতাধিক পরিবারের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছেন খাদ্যসামগ্রী। শুধু নিজের গ্রাম হামিদপুরের দরিদ্র গ্রামবাসীকেই খাদ্যসামগ্রী দেননি। প্রতিবেশী গ্রাম সাদাপুর, তুলাপুর, বেরকুরি, মোল্লাবাড়ি, বিলবাড়ি, শাহপুর, আবদুল্লাহপুরসহ আশপাশের গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন।


খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল চাল, ডাল, আলু, তেল প্রভৃতি। ঈদুল ফিতরের আগের দিন এলাকার খেয়াঘাট বাজারে অটোরিকশার ৩৫ জন চালককে একটা করে লুঙ্গি দিয়েছেন। লুঙ্গি বিতরণে সহযোগিতা করেছেন খেয়াঘাট বাজার অটোরিকশা চালক সমিতির সদস্য সরাফত আলী। পাশের ইউনিয়ন উত্তরভাগ থেকেও দরিদ্র মানুষের একটি তালিকা তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই এই দরিদ্র মানুষগুলোকেও তিনি সহযোগিতা করবেন বলে জানা গেছে।


এর বাইরেও বিভিন্ন সময় মনজুর হোসেন দরিদ্র মানুষকে সহযোগিতা করে আসছেন। গত বছর শীতকালে এলাকার প্রায় ৪০০ গরিব মানুষকে কম্বল দিয়েছেন। তিন বছর ধরে শীতকালে নিয়মিত এই কম্বল তিনি বিতরণ করেন। ইউনিয়নের কাশিমপুরের একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরেও একটি হুইল চেয়ার পাচ্ছে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ রকম একটি সংবাদ দেখে নিজে থেকেই ওই প্রতিবন্ধী মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হুইল চেয়ার দিয়েছেন।


৩ জুন মনজুর হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি এখন পর্তুগালেই আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে থাকতে আমি তেমন কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। প্রবাসেই আছি। কিন্তু মানুষকে সহযোগিতার মনমানসিকতা শুরু থেকেই ছিল। যখন সামর্থ্য হয়েছে, আশপাশের মানুষের দিকে খেয়াল রেখেছি। মানুষকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছি।’


মনজুর হোসেন বলেন, ‘এই সংকটের সময় মানুষ কত অভাব-অনটনে আছেন। গ্রামের কে কী অবস্থায় আছেন। সবাইকে জানি। টাকা-পয়সা সব সময় থাকবে না। তাই প্রথমে দেশে মায়ের সঙ্গে আলাপ করি। মা বললেন, “সামর্থ্য থাকলে দাও।” এরপর বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। তিনিও সমর্থন দিলেন। এরপর তাঁদের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি এলাকার দরিদ্র মানুষের পাশে থাকার। স্থানীয়ভাবে আমার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। সব সময়ই মানুষকে যতটা পারি সহযোগিতার চেষ্টা থাকবে।’


খেয়াঘাট বাজার অটোরিকশা চালক সমিতির সদস্য সরাফত আলী আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই করোনার দুর্যোগের সময় তাইন (মনজুর হোসেন) আমরা গরিব-গোর্বারে ভালা একটা সহযোগিতা করছইন। চাইর শ পরিবাররে চাউল, ডাইল, তেল ইত্যাদি দিছইন। এ ছাড়াও গ্রামের বাইরের অনেকরে দিছইন। ঈদ উপলক্ষে আমরারে (রিকশাচালক) লুঙ্গি দিছইন। কাশিমপুরে এক প্রতিবন্ধী মেয়ের পরিবাররে খাবার ও হুইল চেয়ার দিছইন। আমার সাথে আলাপে ভবিষ্যতে গরিবের মেয়েদের বিয়েতেও সহযোগিতা করবা কইছইন।'
ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রফিক উদ্দিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সময়ে মনজুর হোসেন ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করেছেন। বিভিন্ন গ্রামের দরিদ্র মানুষের তালিকা করে গাড়ি দিয়ে বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছানো হয়েছে।’