দুধের ক্রেতা নেই, মাথায় হাত খামারিদের

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন দুগ্ধ খামারিরা। হোটেল ও চায়ের দোকান বন্ধ। দুধ কিনছে না সাধারণ মানুষও। ফলে পানির দামেও দুধ বিক্রি করতে পারছেন না খামারিরা। গতকাল পাবনার টেবুনিয়া হাটে। ছবি: হাসান মাহমুদ
করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন দুগ্ধ খামারিরা। হোটেল ও চায়ের দোকান বন্ধ। দুধ কিনছে না সাধারণ মানুষও। ফলে পানির দামেও দুধ বিক্রি করতে পারছেন না খামারিরা। গতকাল পাবনার টেবুনিয়া হাটে। ছবি: হাসান মাহমুদ

ঈদের পর পাবনা ও সিরাজগঞ্জের দুগ্ধ খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ফলে বেচা–বিক্রি কমে লোকসানের মুখে খামারিরা। উল্টো বেড়েছে গোখাদ্যের দাম। সবমিলিয়ে করোনাভাইরাস সৃষ্ট এই পরিস্থিতিতে দুঃসময়ের মুখোমুখি খামারিরা।

স্থানীয় খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতেই বিপাকে পড়েন পাবনা ও সিরাজগঞ্জের খামারিরা। স্থানীয় দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ নেওয়া কমিয়ে দেওয়ায় খোলা বাজারে পানির দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হন তাঁরা। তবে রমজান মাসে দুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আশার আলো দেখছিলেন খামারিরা। ওই সময় প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে আগ্রহ দেখিয়ে যেমন দুধ কিনেছে, তেমনি খোলা বাজারেও মিলেছে ভালো দাম। এমন অবস্থা বজায় ছিল ঈদুল ফিতরের পর আরও প্রায় সপ্তাহখানিক। কিন্তু এখন আবারও খামারিদের দুঃসময় ফিরে এসেছে। চাহিদা পড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। খোলা বাজারে লোকসানে দুধ বিক্রি করছেন খামারিরা। এর ওপর হঠাৎ করে গোখ্যাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি খামারিদের কাছে 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার কয়েকটি উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। এ অঞ্চলের ২৫ হাজারেরও বেশি খামারে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত দুধ মিল্ক ভিটা, আড়ং দুধ (ব্র্যাক), প্রাণ, ফার্মফ্রেস, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরি, সেফ মিল্কসহ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে বিক্রি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিলেই এ এলাকার দুগ্ধশিল্পে নেমে আসে বিপর্যয়। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে খামারিরা উৎপাদিত দুধ নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় স্থানীয় বাজারে খামারিরা ১৫ থেকে ২০ টাকা লিটার দরেও দুধ বিক্রি করেন। কোনো কোনো খামারি আবার ননি তুলে রেখে বাকি দুধ ফেলে দিতে বাধ্য হন।

গত রমজান মাসে দুধের চাহিদা বাড়তে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোও খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা বাড়াতে থাকে। এমনকি দুধের সংগ্রহমূল্যও বাড়ানো হয়। এমনিতে প্রতিষ্ঠানগুলো ৪০ থেকে ৪২ টাকা লিটার দরে দুধ সংগ্রহ করে থাকলেও রমজান মাসে বেসরকারি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ৪৫ থেকে ৫০ টাকা লিটার দরেও দুধ সংগ্রহ করে। এ ছাড়া খামারিরা খোলা বাজারে ও ছানার কারখানায় এর চেয়েও বেশি দামে দুধ বিক্রি করতে থাকেন। ঈদুল ফিতরের পরে আরও সপ্তাহখানেক খামারিরা এমন দামে দুধ বিক্রি করেন। এভাবে দুধ বিক্রি করায় ও দুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা আশার আলো দেখতে থাকেন। অনেকেই মনে করেছিলেন, দুঃসময় কেটে গিয়ে খামারিদের সুসময় ফিরে এসেছে।

কিন্তু চার-পাঁচদিন হলো খামারিদের আবারও দুঃসময় ফিরে এসেছে। প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও ছানা তৈরির কারখানাগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় খামারিরা দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। খোলা বাজারে ও কিছু ছানা তৈরির কারখানায় খামারিদের ৩০ থেকে ৪০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। খামারিরা আশঙ্কা করছেন, দাম আরও কমে যাবে।

এদিকে খামারিরা বলছেন, ঈদুল ফিতরের পর থেকে গোখাদ্যের দাম উল্টো বেড়ে চলেছে। এক হাজার ২৫০ টাকা দামের (৩৭ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা) ভুসির দাম ঈদুল ফিতরের পরে হয়েছে এক হাজার ৪২০ টাকা। ৩০০ টাকা মণের খরের দাম হয়েছে ৪০০ টাকা। খৈল, চিটাগুড়সহ সব ধরনের গোখাদ্যের দামই বেড়েছে।

বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার খামারি আব্দুল মোমিন বলেন, 'রমজান মাস আসার পর মনে করছিল্যাম আমাগরে দুঃসময় বুঝি চইল্যা গেল। কিন্তু এখন দেখতেছি আমাগরে কপালে সুখ নাই। লোকসানে দুধ বেইচ্যা চড়াদামে গোখাদ্য কেনা লাগত্যাছে।'

বেড়া পৌর এলাকার বনগ্রাম মহল্লার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজা মীনা বলেন, 'আমার খামারে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ লিটার দুধ হয়। গত একমাস ভালো দামে বিক্রি করার পর আবারও উৎপাদিত দুধ নিয়ে বিপাকে পড়ছি। যে প্রতিষ্ঠানে আগে দুধ দিতাম, তারা এখন আর নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে স্থানীয় বাজারে কম দামে দুধ বেচা লাগছে।'

সাঁথিয়ার আমাইকোলা গ্রামের দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান সেফ মিল্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ শেখ বলেন, 'করোনা প্রাদুর্ভাবে আমাদের দুধ সংগ্রহ নেমে এসেছিল প্রতি দিন ৫০০ থেকে এক হাজার লিটারে। কিন্তু রমজান মাসে আমরা প্রতি দিন পাঁচ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠিয়েছি। তখন আমরা প্রতি লিটারের সংগ্রহ মূল্য ৫০ টাকার কাছাকাছি করেছিলাম। অথচ এখন প্রতি লিটার ৩৫ থেকে ৪০ টাকা সংগ্রহ মূল্যেও খামারিরা আমাদের কাছে দুধ বিক্রির জন্য ধর্না দিচ্ছে। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার লিটারের বেশি দুধ আমরা নিতে পারছি না।'