করোনাকালে শিশুদের প্রশ্ন: 'মা, আমরা এখন স্কুলে যাই না কেন'

ঘরবন্দী শিশুকে উৎফুল্ল রাখতে বাড়ির আঙিনায় দোলনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এক অভিভাবক। সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকায়। ছবি: সাদিক মৃধা
ঘরবন্দী শিশুকে উৎফুল্ল রাখতে বাড়ির আঙিনায় দোলনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এক অভিভাবক। সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকায়। ছবি: সাদিক মৃধা

ছোট্ট তাকিয়া তার মাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে ‘মা, আমরা এখন স্কুলে যাই না কেন।’ নার্সারিতে পড়া মেয়ের কাছে মায়ের দেওয়া উত্তর বোধগম্য হয় না। কিছু না বুঝেই আবারো তার প্রশ্ন, ‘তাহলে কি স্কুলে যাব না?’

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ। ঘরে বসেই দিনের পুরোটা সময় কাটছে শিশুদের। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা কেওয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহিনুর আক্তার ২৮ মে সকালে মেয়ের বলা কথাগুলো জানাচ্ছিলেন এই প্রতিবেদককে। ওই মা জানালেন সদ্য স্কুলে যাওয়া শুরু করা তাঁর মেয়ের অবুঝ মনের ব্যাকুলতার কথা। শাহিনুর এ–ও বলেন, ‘বাচ্চাদের ঘরে রাখাই কঠিন। কিন্তু তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই জোর করে ঘরে রাখতে হচ্ছে।’

২৮ মে শ্রীপুরের কাইচাবাড়ি গ্রামের বাড়ির পাশের একটি মাঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল ৫-৬টি শিশু। স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই দুজন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘না আঙ্কেল, আমরা তো এখন স্কুলে যাই না। স্কুল তো বন্ধ। এখন খেলি আমরা।’ স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে একজন বলে, ‘ভালো লাগে, খেলি আমরা। ইস্কুল খোলা হইলেই ম্যাডাম আম্মুকে ফোন দেবে।’

ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবিদ কায়সান অপূর্ব। সে দুই মাসের বেশি সময় ঢাকা ছেড়ে মা-বাবার সঙ্গে শ্রীপুরের বাড়িতে অবস্থান করছে। আবিদ কায়সান বলে, ‘স্কুলে যেতে ইচ্ছে করলেই তো আর যেতে পারব না। এখন আমরা মা-বাবার সাথে একদম ঘরে আছি। খেলতে ইচ্ছা হলে ছাদে গিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে ঘুরে আসি। ছাদে ঘুড়ি ওড়াই আমরা।’ তার মা কাকলি আক্তার বলেন, ‘বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনায় খুব সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া তাদের মনের অবস্থাও ভালো না। কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না। ছাদ আর ঘর, এই দুই জায়গায় এখন আমার সন্তানদের সীমানা।’

নাট্যকার ও প্রভাষক মুমিনুল ইসলাম তাঁর মেয়ে রোজমিলাকে নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মেয়ে রোজমিলা বলে, বাবা, লকডাউন কবে শেষ হবে? আর ভালো লাগে না। আমাদের স্কুল কি এ বছর আর খুলবে না? স্কুল না খুলুক, স্যারদের বলো না ক্লাসপার্টিগুলো চালু করতে। আমাদের স্কুলের সবাই কি ঘরে আটকা পড়ে আছে? বাবা, লকডাউন একবার শুরু হলে কি আর শেষ হয় না? রোজমিলার মন ভালো নেই। ওর কোনো প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।...’

নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইসা আমরিন। দীর্ঘদিন স্কুলে না গিয়ে সে মায়ের সাঙ্গে বাসায় অবস্থান করছে। তার মা শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘মেয়ে খালি আমকে বলে, মা স্কুলে কবে যাব। কবে খুলবে আমাদের স্কুল। স্যারকে একটু ফোন দাও না, আমি তখন তাকে কিছু বলতে পারি না।’ তিনি বলেন, বাসায় রেখে তার পড়াশোনার ক্ষতিটা পূরণ করতে চেষ্টা করছেন। এখনো বুঝতে পারছেন না এই শিশুদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক উপাধ্যক্ষ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেওয়ান আবদুল রহীম শিশুদের ঘরে থাকার বিষয়টিকে কিছুটা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তবে তিনি শিশু ও অভিভাবকদের জন্য পরামর্শও দিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বাচ্চারা ঘরে থাকার একটি ভালো দিক আছে। তারা পিতা-মাতাকে সঙ্গ পাচ্ছে। আগে এতটা কাছে পেত না তারা। ঘরে থাকার কারণে মা-বাবার সঙ্গে তাদের বন্ধনটা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। তবে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে এটা ঠিক। এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকে ভূমিকা নিতে হবে।

দেওয়ান আবদুল রহীম বলেন, ঘরে থাকা অবস্থায় শিশুকে স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের ওপর কোনো বিষয়েই জোর খাটানো ঠিক হবে না। তাকে তার মতো করে চলতে দিতে হবে। তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে বাড়ির আশপাশে কিংবা ছাদে ঘুরতে দেওয়া যেতে পারে। ঘরে থাকার ফলে শিশুরা মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সচেতন থাকতে হবে।