২০-২৫ সেকেন্ডের টর্নেডোয় লন্ডভন্ড পাঁচ-ছয়টি গ্রাম

কয়েক সেকেন্ডের টর্নেডোয় লন্ডভন্ড ঘরবাড়ি। নাসিরনগর উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়ায়। ছবি: প্রথম আলো।
কয়েক সেকেন্ডের টর্নেডোয় লন্ডভন্ড ঘরবাড়ি। নাসিরনগর উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়ায়। ছবি: প্রথম আলো।

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মাত্র কয়েক মাস আগে একটি টিনের ঘর নির্মাণ করেছিলেন জেলে এন্তু দাস (৬০)। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে কোনোমতে সংসার চলছিল। দিন আনে দিন খায় এমন অবস্থা। কয়েক সেকেন্ডের ভয়াল টর্নেডো এন্তুর সংসার তছনছ করে দিল। একমাত্র সম্বল ঘরের টিনের চাল, আসবাব ও খাবার উড়িয়ে নিয়ে গেছে তাঁর।

এন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা। আজ শনিবার সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে উপজেলার সদর ও বুড়িশ্বর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে টর্নেডো আঘাত হানে। এতে দুই ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এন্তুসহ অনেক পরিবারের এখন চরম দুর্দশায়।

এন্তু পেশায় জেলে। তাঁর স্ত্রী অনিতা দাস বিভিন্ন বাড়িতে মাটির কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে দিনে চার-পাঁচ শ টাকা আয় করেন। এতেই সংসারের চুলা জ্বলে। তবে বর্তমানে নদী ও হাওরে তেমন পানি না থাকায় মাছ শিকারে গিয়েও তেমন আয় করতে পারেন না। এন্তু আজ সকালে মাছ ধরতে হাওরে গেলেও টর্নেডোর জন্য বাড়ি ফিরে যান। বাড়ি ফিরে দেখেন, ঘরের কিছুই অবশিষ্ট নেই। ২০-২৫ সেকেন্ডের টর্নেডো তাঁর পরিবারের সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঘরে চাল পানির সঙ্গে ভেসে গেছে।

ধ্বংসস্তূপে পরিণত গোটা বাড়িঘর। ছবি: প্রথম আলো।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত গোটা বাড়িঘর। ছবি: প্রথম আলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার দিকে নাসিরনগর উপজেলায় টর্নেডো আঘাত হানে। কয়েক সেকেন্ডে উপজেলা সদরের ৭ নম্বর ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড, বুড়িশ্বর ইউনিয়নের আশুরাইল, বেনিপাড়া, ইছাপুরা, শ্রীঘর গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নাসিরনগর ডাকবাংলার এলাকা–সংলগ্ন হাওরে থাকা নৌকা, উপজেলার বিভিন্ন বাড়িঘরের টিনের চাল ও আসবাব, অনেক গাছপালা, খামারের চাল বিধ্বস্ত করাসহ উড়িয়ে নিয়ে যায়। টর্নেডো অনেক ঘরের টিনের চাল উড়িয়ে গাছের ডালে নিয়ে যায়। উপজেলা সদরের আশুতোষ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, উপজেলার কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মন্দির, দুটি ট্রান্সফরমার, একটি বিদ্যুতের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

টর্নেডোর আঘাতে বুড়িশ্বর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও বিজয়নগরে একটি ডাকঘরের পোস্টমাস্টার সোহেল আহমেদ (৪৫) নিহত ও সাতজন আহত হন।

এন্তুর স্ত্রী অনিতা দাস বলেন, ঘরে স্বামী ও তিনি উপার্জন করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে অন্তরা দাস, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে রিয়া দাস এবং প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশু ছেলে মিঠুন দাসকে নিয়ে তাঁর সংসার। স্বামী পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ তোলেন। সেই টাকায় টিনের ঘরটি নির্মাণ করেন। কিন্তু ভয়াল টর্নেডো সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে। তছনছ করে দিয়ে গেছে পুরো ঘর। কয়েক দিন আগে জমানো টাকা দিয়ে এক মণ চাল কেনেন। সেই চালও পানির সঙ্গে ভেসে গেছে। তিনি বলেন, সকালে টর্নেডো শুরু হলে ঘর থেকে বের হয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেন। কয়েক মিনিট পর এসে দেখেন সব শেষ।

বসতঘরের চাল, আসবাব উড়ে পাশের নদীতে গিয়ে পড়েছে। ছবি: প্রথম আলো।
বসতঘরের চাল, আসবাব উড়ে পাশের নদীতে গিয়ে পড়েছে। ছবি: প্রথম আলো।

একই পাড়ার আরেক অসহায় প্রণতি রানী দাসেরও (৩৬) টিনের ঘর ও আসবাব সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে। তাঁর স্বামী শ্যামল দাস বেকার। এক মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার। মাটির কাজ করে প্রতিদিন ২০০ টাকা পান। প্রণতি রানী দাস বলেন, ছয় থেকে সাত মাস আগে ব্র্যাক থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে টিনের ঘর নির্মাণ করেছিলেন। গত বছরও ঝড়ে তাদের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এবার টর্নেডো সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেছে।

নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমা আশরাফী বলেন, উপজেলার পাঁচ থেকে ছয়টি গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ৬০টি বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।