'সামনে কী হবে, চিন্তায় মাথা কাজ করে না'

দেলোয়ার হোসেন
দেলোয়ার হোসেন

আট বছর ধরে রংতুলির আঁচড়ে অন্যের ঘর রাঙিয়ে তুলছেন। তবে নিজের ঘর-সংসারটা পুরো গুছিয়ে উঠতে পারেননি। মা, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকেন মাটির দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট ঘরে। মাসে যে আয় ছিল, তাতে খুব আয়েশে দিন না কাটলেও মুখে হাসি ছিল, সংসারে সুখ ছিল। পরিবারের সেই হাসিমাখা মুখ মলিন করে দিয়েছে করোনাভাইরাস।

এই ব্যক্তি হলেন দেলোয়ার হোসেন। বয়স ৩২ বছর। পেশায় রংমিস্ত্রি। থাকেন খুলনার লবণচরা থানা এলাকার হরিণটানা ফজলুল বারী স্কুলের পাশে। অদৃশ্য ভাইরাস করোনার প্রভাবে প্রায় আড়াই মাস ধরে কর্মহীন দেলোয়ার। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চেয়ে চিন্তে আর ধার-দেনা করে কোনোমতে টিমটিম করে চলছে সংসার। কাজ নেই, জমানো টাকা নেই, বাড়ছে দেনা—সবমিলিয়ে অনেকটা দিশেহারা তিনি।

দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয়বারের মতো কাজে বের হয়েছিলেন দেলোয়ার। নগরের পূর্ব বানিয়াখামার এলাকায় পরিচিত এক বাড়িতে কাজ করার সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন, আদি বাড়ি ভোলায়। সেখান থেকে তাঁর দাদা খুলনা আসেন। এরপর তাঁর বাবা ২৫ বছর আগে বটিয়াঘাটায় জলমা ইউনিয়নের মধ্যে হরিণটানা বিলে জায়গা কেনেন। এখন ওই জায়গায় রাস্তাঘাট হয়েছে। জলমা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেলোয়ার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে শুরু করেন রংমিস্ত্রির কাজ।

দেলোয়ার বলেন, 'করোনার আগে মাসে ১৩-১৪ হাজার টাকা আয় হইতো। ভালোভাবে চুইলে যাইতো। সংসারে সুখ ছেলো। ভাইরাস আসার পর থাইকেই কাজ বন্ধ হইয়ে যাওয়ায় ভীষণ কষ্টে পড়িছি। আজ ধইরে দ্বিতীয় দিনির মতো কাজে আসলাম। গত দুই মাস ধইরে শুধু শাক-সবজি ও ডাল-ভাত খাইয়ে আছি। কোনোদিন ভালো মাছ-মাংস কিনিনি। মাঝে মাঝে না খাইয়েও থাকতি হইয়েছে।'

২০১৩ সালে বিয়ে করেছেন দেলোয়ার। দুই সন্তান তাঁর। ৫ বছরের মেয়েটা একটু আধটু পড়তে শিখেছে। ছেলেটার বয়স ২ বছর। দেলোয়ার বলছিলেন, 'ভাই সত্যি বলতি, মাঝে মাঝে বাচ্চা দুইটোর দিকি তাকালি চোখ দিয়ে পানি চুইলে আসে। ওদের নিয়ে চলব কি কইরে। মুরব্বিদের কাছে ৭৪ সালের অভাবের কথা শুনিছি। এখন বোধহয় তাঁর চেয়ে বেশি খারাপ সময় যাচ্ছে।'

শহরতলিতে বাড়ি হওয়ায় কাজে যাওয়ার জন্য নিজের একটা সাইকেল ছিল দেলোয়ারের। সংসার চালাতে গিয়ে সেটাও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ভীষণ মন খারাপ করে দেলোয়ার বলছিলেন, বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে খুব সস্তায় সাইকেলটা বিক্রি করে দিয়েছেন।

এবারের ঈদটাও ভীষণ খারাপ কেটেছে দেলোয়ারের। নিজ থেকে সেই প্রসঙ্গ টেনে তিনি বললেন, এ রকম খারাপ ঈদ আগে কখনো কাটেনি। একটা সুতো পর্যন্ত কিনতে পারেননি। ২০১৫ সালে মারা যাওয়া বাবার পাঞ্জাবি পরে ঈদ করেছেন। আর স্ত্রী ঘরে থাকা কাপড় দিয়ে দুই বাচ্চাকে জামা বানিয়ে দিয়েছেন।

ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকা দেলোয়ার বলেন, 'করোনা তো সারা দুনিয়া থামিয়ে দিয়ে গেল। জীবন চলে না। জীবিকা শেষ। সামনে কী হবে, চিন্তায় মাথা কাজ করে না। মনে করেছিলাম লকডাউনের পর থেকে কাজ–কাম হবে। আগে বেশ কিছু কাজ ধরাও ছিল। সেসব বাড়ির মালিকেরা বলছেন, এখন কাজ করাবেন না।'

কর্মহীন হওয়ার পর থেকে আত্মীয়-স্বজন ছাড়া কারও কাছ থেকে কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি বলে জানালেন দেলোয়ার। ধার-দেনা করেই সংসার চালাতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে নেওয়া ধারের টাকা শোধ করার মতো অবস্থা নেই এখন। আর মানুষের কাছেই বা কতবার চাওয়া যায়!

দেলোয়ার জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দেওয়া আড়াই হাজার টাকা বা সরকারি অন্য সহায়তা পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। তবে সেখানেও তিনি ব্যর্থ। বললেন, 'ভোটার আইডি কার্ড জমা দিয়েছি দুই–তিনবার। চেষ্টা–তদবিরও করেছি। তবে কিছু পাইনি। অনেক বড়লোকও পেয়েছে। তবে আমরা পাইনি।'