৭ জুন একটি ভাস্বর দিন

তোফায়েল আহমেদ
তোফায়েল আহমেদ

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। শেখ ফজলুল হক মনি, আমাদের প্রিয় মনি ভাইসহ সর্বজনাব সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে—আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

আমার স্মৃতিপটে এখনো ভাস্বর হয়ে আছে দিনটি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মনি ভাই এসেছেন হরতালের পক্ষে প্রচারকাজ চালানোর জন্য। তিনি তখন ছাত্র নন। ড. ওয়াদুদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। তিনি মনি ভাইকে বললেন, ‘মনি, তুমি এখন ছাত্র নও। তুমি ক্যাম্পাসে অবস্থান কোরো না, চলে যাও। তুমি যদি না যাও, তবে আমার চাকরি যাবে।’ মনি ভাই স্যারের কথায় সবিনয়ে সম্মতি জানিয়ে আমাদের হরতাল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।

সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটি ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। ফলে তেজগাঁওয়ে শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তাঁরা সেখানে বক্তৃতা করেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু।...

ছয় দফার পক্ষে ৭ জুনের হরতাল এতটাই সর্বব্যাপী ছিল যে এ সম্পর্কে কোনো রকম প্রতিবেদন মুদ্রণ ও প্রকাশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও মানিক মিয়া তাঁর কলামে লেখেন, ছয় দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর ব্যবস্থাদির কারণে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একমাত্র সান্ত্বনার বিষয় হলো এই যে জনসাধারণ ছয় দফা আন্দোলন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে।

৭ জুনের সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি ও ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরিতে ইত্তেফাক–এর ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২(১) ধারার আওতায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার এবং দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করে।...

৭ জুন যে সার্বভৌম পার্লামেন্টের দাবিতে আমরা ছয় দফার পক্ষে সংগ্রাম করেছিলাম, সেই কর্মসূচির ফলই হচ্ছে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। ৭ জুন ছিল এর সূচনাবিন্দু।

‘ছয় দফা: শহীদের রক্তে লেখা’ থেকে (সূত্র: বাংলানিউজ২৪)

তোফায়েল আহমেদ: সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি